এমপি গোলাম রাব্বানীর বহিস্কার > উপলক্ষ নির্বাচন : আড়ালে এমপি-এমপি দ্বন্দ্ব

ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানীকে আওয়ামীলীগ থেকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হয়েছে। চলতি পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর ‘বিপক্ষে’ অবস্থান নেয়ার কথা উল্লেখ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মইনুদ্দীন মন্ডল ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ এমপি স্বাক্ষরিত এক পত্র বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় গণমাধ্যম ও কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে বহিস্কার করা হয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আতাউরর রহমান ও শিবগঞ্জ পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং চলতি নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কারিবুল হক রাজিনকে। এদিকে, দলীয় সংসদ সদস্যকে দল থেকে সাময়িক বহিস্কারের ঘটনাকে ঘিরে আভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। সাময়িক বহিস্কারের ‘এখতিয়ার’ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন নিয়ে ‘বিনাভোটে’ নির্বাচিত হন গোলাম রাব্বানী। আগে থেকে আওয়ামীলীগ না করা পল্লী বিদ্যুৎ আন্দোলনের এই নেতা শিবগঞ্জ আওয়ামীলীগের একাংশকে একত্রিত করে নিজের অবস্থান তৈরী করেন। নিজ ‘বলয়ে’ ভেরানো চেষ্টা করেন বহু নাশকতার মামলার আসামী বিএনপি নেতাদেরকেও। সংগঠনের ভঙ্গুর অবস্থার মাঝেই শিবগঞ্জ আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্বের জের ধরে উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অবস্থান নেন গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে। তারা গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে নানা ‘অনিয়মের’  অভিযোগ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ বিভিন্ন অফিসে পাঠান। তবে, বিরুদ্ধাচারণ করা ওই নেতাদের অধিকাংশজনকেই ‘ম্যানেজ’ করে গোলাম রাব্বানী ফিরেয়ে আনেন নিজ ‘বলয়ে’। ওই সূত্র জানায়, গোলাম রাব্বানী সংগঠনের ভেতর নিজের অবস্থান শক্ত করে উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতিও নির্বাচিত হন। এমপি’র প্রভাব ও সংগঠনের মধ্যে ‘অবস্থান’ তৈরীর মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হলেও দলের পুরোনো অংশের নেতাকর্মীরা থেকে যা তার বিরুদ্ধেই।
দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে,  সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত জেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হতে তৎপরতা শুরু করেন। ফলে গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে জেলা সদরের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ এবং বর্তমান সভাপতি মইনুদ্দীন মন্ডলের মধ্যে অভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ওই সূত্র জানায়, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মইনুদ্দীন মন্ডলের সঙ্গে ‘সভাপতি’ হওয়াকে ঘিরে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেও গোলাম রাব্বানী এমপি’র সঙ্গে আব্দুল ওদুদ এমপি’র দ্বন্দ্ব সৃষ্টি ক্ষমতা ও আধিপত্যকে ঘিরে।
আওয়ামীলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, গোলাম রাব্বানীর সংসদীয় এলাকার মধ্যে থাকা সোনামসজিদ স্থল বন্দরের ‘দখল’ কিংবা ‘অংশিদারিত্ব’ নিয়ে আব্দুল ওদুদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলেও তা প্রকট আকার ধারণ করে শিবগঞ্জ পৌরসাভার মর্দনা এলাকায় আওয়ামীলীগে দু’গ্রুপের দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পৃষ্টপোশকতাকে ঘিরে। মর্দনা এলাকায় আওয়ামীলীগ নেতা পৌর কাউন্সিলর আব্দুস সালাম বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামীলীগ নেতা সফিকুল ইসলাম পাশবান ও জেম বাহিনীর দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রায় ৪/৫ মাস আগে দফায় দফায় ওই এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ওই দ্বন্দ্বের জেরে রবিউল ইসলাম নামের সালাম গ্রুপের এক যুবক নিহত হয়। বহু বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, মর্দনার ওই দ্বন্দ্বে সালাম গ্রুপকে পৃষ্টপোশকতা করেন গোলাম রাব্বনী আর পাশবান-জেম গ্রুপকে পৃষ্টপোশকতা প্রদান করেন আব্দুল ওদুদ। সূত্রগুলো জানিয়েছে, দু’ এমপি’র পৃষ্টপোশকতার কারণে মর্দনা সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিতি পায় এবং সংঘর্ষ দফায় দফায় প্রায় দু’ মাস ধরে চলতে থাকতে। মামলা পাল্টা মামলা দায়েরকে ঘিরে দু’ এমপি দু’ মেরুতে অবস্থান নেয়।
দলীয় সূত্র জানায়, পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে গোলাম রাব্বানী কানসাট ইউনিয়নস্থ তার বাড়ির সামনে রাসেল স্মৃতি মিলনায়তনে পৌর আওয়ামীলীগের এক সভা ডেকে তার ‘আর্শিবাদপুষ্ট’ শিবগঞ্জ পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক কারিবুল হক রাজিনকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পর রাজিন নিজেকে তৃণমূল আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে প্রচার প্রচারণা শুরু করেন। এদিকে, বাধ সাধেন ওই সভা ত্যাগ করে চলে আসা শিবগঞ্জ পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি আতিকুল ইসলাম টুটুল। জেলা সদরে এসে গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলনও করেন। শিবগঞ্জের আওয়ামীলীগের একাংশ ও টুটুল গ্রুপ স্মরণাপন্ন হন জেলা আওয়ামীলীগের দু’ র্শীষনেতা মন্ডল ও ওদুদের কাছে। সর্বশেষ অভ্যান্তরিণ লবিং-এ দলীয় মনোনয়ন পান মন্ডল-ওদুদ ‘ঘরানা’র ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ময়েন খান। তবে এ সিদ্ধান্তকে অমান্য করে মাঠে থেকে যান কারিবুল হক রাজিন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলের সূত্রগুলো জানিয়েছে, নৌকা প্রতিকের প্রার্থীর পক্ষে শিবগঞ্জ আওয়ামীলীগের অনেক নেতা চলে আসলেও তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা রাজিনের পক্ষে থেকে যাওয়ায় ‘বিব্রতকর’ অবস্থার মধ্যে পড়ে আওয়ামীলীগ। কেন্দ্র ও জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ্ব দফায় দফায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন গোলাম রাব্বানীর ‘আর্শিবাদপুষ্ট’ রাজিনকে প্রার্থী থেকে সরে দাঁড়াতে।  জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মইনুদ্দীন মন্ডল ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ’র সঙ্গে গোলাম রাব্বানীর পুর্বের দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচন নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির ‘সুযোগে’ কঠোর অবস্থান নেন জেলা আওয়ামীলীগে দু’ শীর্ষ নেতা মন্ডল ও ওদুদ। বৃহস্পতিবার রাতে জেলা আওয়ামীলীগের নামে কম্পিউটার কম্পোজ করা প্যাডে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে পাঠানো এক পত্রে জানানো হয়েছে, শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি গেলাম রাব্বানী, সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আতাউর রহমান ও শিবগঞ্জ পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পদাক কারিবুল হক রাজিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনটি পৃথক পত্রে এ বরখাস্ত করা হয়। ওই পত্রে উল্লেখ করা হয়,  আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয কমিটি শিবগঞ্জ পৌরসভাসহ সব পৌরসভায় নৌকা প্রতিক দিয়ে দলের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। শিবগঞ্জ পৌরসভায় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে আব্দুল ময়েন খানকে। মৌখিকভাবে ও বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অনুরোধ জানানোর পরেও সংসদ সদস্য ও শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিষয়টিকে সংগঠনের স্বার্থ, আদর্শ পরিপন্থি কাজ উল্লেখ করে ওই পত্রে জানানো হয়, জেলা আওয়ামীলীগের গত ২১ সেপ্টেম্বর তারিখের কার্যকরি পরিষদের সিদ্ধান্ত ও গঠনতন্ত্রের আলোকে তাদের সকল পদ-পদবী থেকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হয়।
ওই পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘ এ মুর্হুত থেকে আপনি শিবগঞ্জ উপজেলা/ শিবগঞ্জ পৌরসভা আওয়ামীল তথা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কোন পর্যায়ের সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়া থেকে বিরত থাকবেন’।
তবে ওই পত্রের শেষ অংশে হাত দিয়ে লেখা বাক্যে বলা হয়েছে, আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন স্বাপেক্ষে চুড়ান্তভাবে বহিস্কার করা হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক আজিজুর রহমান জানান, পৃথক পৃথকভাবে গোলাম রাব্বানী, আতাউর রহমান ও কারিবুল হক রাজিনের সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে, শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আতাউর রহমান বলেন, ‘জেলার নির্দেশনা অনুযায়ী শিবগঞ্জ পৌরসভার আওয়ামীলীগের নেতাদের সমন্বয়ে সভা করে রাজিনকে প্রার্থী করা হয়েছিল। এরপর প্রার্থী দিয়েছে অন্যজনকে আমি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনই অবস্থান নেইনি। তবুও পুর্বের রাগ তুলতেই জেলা নেতারা একাজটি করেছেন’। তিনি বলেন, কোন সভা না করে, কোন নোটিশ না দিয়ে হীন উদ্যেশ্যে ও একেবারে উদ্দ্যেশ্য প্রণোদিত হয়ে বহিস্কারের পত্র দেয়া হয়েছে যা অগণতান্ত্রিক ও অগঠনতান্ত্রিক। তিনি গঠনতন্ত্র পরিপন্থি কাজ করার জন্য উল্টো জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন’।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মইনুদ্দীন মন্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,  ‘ বারবার বলার পরেও তারা নৌকা প্রতিকের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। নৌকা সর্বোচ্চ যায়গা হওয়ার পরেও তারা বিরোধীতা করায় গঠনতন্ত্র মোতাবেকই তাদের সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে’।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ২৬-১২-১৫

,