সাংস্কৃতিক ইতিহাস

সাংস্কৃতিক ইতিহাস একগুচ্ছ নিয়মকে সংজ্ঞায়িত করে না অথবা কোন বিষয়ের বিষয়বস্তুর স্বতন্ত্র চিহ্নিত করে না। জার্মান শব্দ ‘কুলটুরগুশিক্তা’কেই শুধুমাত্র উচ্চ সংস্কৃতিই প্রকাশ করে না, এর সঙ্গে বিশেষভাবে প্রতীকি এবং আচার ভিত্তিক অতীতের সংস্কতিকে ব্যাখ্যা করে। কিছু পর্যবেক্ষক হতাশ হয়ে পড়েন, এই দেখে যে, সাংস্কৃতিক ইতিহাস মনে হয় ইতিহাসের সব কিছু, কোন প্রকার ব্যাখ্যা ছাড়ায়। এখানে এক মুঠো সত্য জানানো জরুরি যে, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের চর্চা আসলে সব বিভাগেই করা সম্ভব, যেমনটা সম্ভব- রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞাতিধারণা, জন (লিঙ্গ), ধর্ম এবং এছাড়াও এই সবগুলোর সঙ্গে যুক্ত কিংবা পরস্পর মিশে থাকা বিদ্যা অঞ্চলে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জনসংখ্যা-বিষয়ক ইতিহাসবিদ যিনি হিসেব করেন ঐতিহাসিকভাবে পরিবারের আকৃতি, অথবা হিসাবের বয়সকাল। সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদগণ অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা করে দেখেন পরিবারের ধারণাগুলো, দায়িত্ব, দাম্পত্য জীবন, স্ববিরোধগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এবং চাপের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রবৃত্তির সংঘর্ষগুলোর ভিতর এর কার্যকরণ খোঁজে। আরেক দিকে. মতবাদ ভিত্তিক বিদ্যাচর্চায়, ধর্ম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন নিয়ে- ধর্ম বিষয়ক ইতিহাসবিদদের দীর্ঘ অধ্যয়ন চলে- সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদরা তল্লাস করে ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে- ধর্মের প্রচার কাজের ধরন, সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ এবং প্রাত্যহিক জীবনে এর ব্যবহার ।
এই সকল কথার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ প্রায়শই একজন ভালো আবিষ্কারক যিনি খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ এবং বিশ্লেষণ করেন। তার কাজের ধরন মানুষের প্রতিদিনকার জীবনকে চিহ্নিত করা, সেই জীবনকে সংরক্ষণ করা নয়। এই বর্তমানে, সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে ‘শুধুমাত্র মানুষের ইতিহাস’ ভাবা ভুল হবে, এটা কাজ করে অনেকটা কোর্টে রাজনীতি এবং সেনাদল যেভাবে কাজ করে; শিল্প এবং পোশাক, সাহিত্য, ব্যাকরণ এবং সংগীত যেভাবে বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত হয় তার মত করে।   
সাংস্কৃতিক ইতিহাস গুরুত্বপুর্ণ একটি বিষয় হয়ে ওঠার আগেও ইতিহাসবিদরা এটি নিয়ে কাজ করেছেন, ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে ১৯৬০এর দশক এবং ১৯৭০ এর দশকের ‘নতুন ইতিহাস’ নিয়ে, যেটি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করে, থেকে তথ্যের ভিত্তিতে সামাজিক সম্পর্ক এবং কাঠামোকে বিশ্লেষণ করার জন্য। শ্রমিকদের জীবন, শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি, কৃষকের অর্থনীতি, বৃক্ষায়নের চিত্র এবং নিন্ম  শ্রেণির মানুষের আয়ের অর্থনীতি, শিক্ষার হার, সমস্ত বিষয় দৃশ্যমান হতে থাকে, প্রথমবারের মত। মার্ক্সের শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্ব জানাশোনা এই সকল কাজগুলোকে উৎসাহ প্রদান করেছে, ফ্রান্সের আদিবাসীদের ইতিহাস এর ভৌগোলিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত, মানসিক এবং শারীরিক উভয় অবস্থায় এর প্রভাব রয়েছে, এই নতুন ধরনের ইতিহাস চর্চায়।  
ই.এম. থমপসন, নাটালি জেমন ডেভিডস এবং ইমানুয়েল লে রয় ল্যাডুরি দেখান যে, কৃষক এবং শিল্পীদের ঐতিহাসিক ভাবে বোঝা সম্ভব এবং ইতিহাসবিদগণ তাদের বুঝতে পারেন তাদের চিন্তা এবং আকাঙ্ক্ষা, কোন শব্দটি তাদের ভালো রাখে এবং কোন শব্দটি তাদের চিন্তিত করে কিংবা কোন চিহ্ন তারা লালন করে অথবা বাতিল করে দেয়। তালিকাবাদী আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে, এই আন্দোলনকে প্রথম অধ্যয়ন করা হয় শ্রেণি ধারণা থেকে, মানুষের চলাফেরার অবাধ গতি এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এর আওতাভুক্ত ছিল। কিন্তু ভাষার বিশ্লেষণ থেকে প্রকাশিত হয় যে, এর মূল কারণ শ্রেণি সংহতি নয় বরং এর সম্পর্ক রয়েছে রাষ্ট্রের গ্রহণ এবং বর্জনের ভিতরে। শ্রেণি সম্পর্ক অধ্যয়নে ইতিহাসবিদকে অনেক বেশিমাত্রায় অনুপ্রোণিত করে কাঠামো এবং আনুগত্য মূলক বিষয় চিহ্নিত করণে।
সবচেয়ে গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া হলো ইতিহাসবিদদের ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসনমূলক পুনঃউপস্থাপন নিয়ে, এই সংগ্রামটিই অন্য এক অর্থ উৎপাদন করে, যেখানে নারী এবং জন (লিঙ্গ) বিষয়ে বেশ অগ্রসর আগ্রহ দেখা গিয়েছিল, কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া আসলে পর্যাপ্ত ছিল না যেখানে বোঝা যায় কিংবা গ্রহণ করা ইতিহাসবিদদের কাছে এবং অন্য পর্যবেক্ষকদের কাছেও একই রকম ছিল।
যদিও প্রথম দিককার ইতিহাসে এর সামান্যই উদাহরণ রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে অধ্যয়নটি ছিল খুব ধীর গতির বিশ শতকের প্রথম দিকের সময়, ১৯৭০ সালের দিক থেকে ‘নারীর ইতিহাস’ বিষয় শাখার একাডেমি চর্চার সূত্রপাত হয়, তখন পর্যন্ত এই জটিল সম্পর্কটি বিশ্বব্যাপী নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওঠেনি। অনেক নারীবাদী এবং যুক্তরাজ্যের অনেক মার্ক্সবাদী নারীবাদী প্রত্যাশা করছিল যে, নারীরা অর্জন করবে অন্যান্য কর্মীদের মতই অধিকার প্রাপ্ত হবে, নানা বর্ণের এবং উপনিবেশিত মানুষের সঙ্গে। এই ইতিহাসের ধারার সঙ্গে কৃষকের ঘরের নারী এবং শ্রমজীবী শ্রেণির পরিবারের নারী এবং উচ্চ বিত্তের নারীর ভিতর একই ধরনের শ্রেণিগত শত্রু ছিল- যা তাদের চেতনার ছোট একটা জায়গায় যুক্ত ছিল। ঐতিহাসিক এই কৌশলের কারণে শ্রমজীবী নারীর জীবন সামনে চলে আসে- যেটা নাকি এ যাবত লুকায়িত ছিল- পরবর্তীতে নারীকে পুনঃআবিষ্কারের আমাদের অভ্যস্ত করে তোলে, কারখানায়, রুটির দাঙ্গায়, ধর্ম যুদ্ধের সময় এবং সর্বস্বান্ত গরিবের ঘরেও।
তখনো, এটি ধীরে ধীরে নারীদের বিষয়ে ইতিহাসবিদদের কাছে পরিষ্কার হতে থাকে যে, নারীরা শুধু মাত্র একটি নিয়মের অর্থনীতির ভিতর দিয়েই যাচ্ছে এমন না, যেটা গরিব কৃষক কিংবা গরিব কারখানার শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করে- পুঁজিবাদ- কিন্তু একগুচ্ছ অধিকার এবং প্রত্যাশা এগুলোকে চালিত করে- গোষ্ঠীপতি শাসিত সমাজে- যেটি তাদের জীবনের ভিতর একধরনের বেঁচে থাকার কাঠামো দান করে তাদের পরিবার এবং সমাজের ভিতর। আরও বলা যায় , ‘গোষ্ঠীপতি শাসিত সমাজ’ সমতা, চিন্তার ভিন্নতা, নারীর জীবন কাঠামো থেকে সামাজিক অবস্থান: আদর্শনারী, ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী, সম্ভান্ত নান অথবা একাডেমিক ভাবে। সামাজিক কাঠামো কোন একক ভাবে নারীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং একদা এটাই স্বীকৃত হয়, অনেক নারী ইতিহাসবিদ এই ধারণা এবং চর্চায় কথা বলে থাকে- যে বিদ্যার নাম আমরা দিয়েছি জন (লিঙ্গ)- পর্যাপ্ত কাজ রয়েছে এই জটিল নারী এবং পুরুষের বাস্তবিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের জন্য।   
নারীবাদী ইতিহাসের ধারা উন্নয়নের ভিতর দিয়ে ইতিহাসের অন্যান্য জায়গাগুলোতেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। জন ওয়াল্চ স্কট্ট এর ‘জেন্ডার এন্ড দ্য পলিটিস অব হিস্টি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি জন বিষয়ক একধরনের সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সাধারণ ইতিহাসের অংশও বটে। ‘নারী’ এবং ‘পুরুষ’  শ্রেণির ভিতর একধরনের বিরোধ বা পার্থক্য দেখানোর পরও তিনি সাংস্কৃতিক পার্থক্য দেখিয়েছেন, যেখানে শারীরিক পার্থক্য দেখানো সহজ ছিল।
 সেই সূত্রধরে তারা গড়ে তোলে অধিকার এবং সংঘ নিজেদের ভিতর যেটির মাধ্যমে তারা ছাড়িয়ে যায় তাদের শারীরিক সক্ষমতার জায়গাকে এবং যার ভিত্তি ইতিহাস এবং ভাষার ভিতর গভীরভাবে প্রাথিত রয়েছে: নারীবাদী সময়ের মধ্যযুগে দেখা যায় সারিবদ্ধ নানান উপসর্গ (সহ্যশীলতার), দূর্বল সাধারণ বিচার, কুটিলতা, বিশ্বাসপ্রবণতা, জীবনের নিম্ন প্রত্যাশা, কার্যকরণের দূর্বলতা এবং অন্যান্য।  
পর্যবেক্ষণযোগ্য বাস্তবতার কিছু মানে তো থাকে, তাছাড়াও ভাষার ভিতর যে বৈষম্য সৃষ্টিকারী মৌলিক চর্চাও হয়, আচার এবং পুনঃউপস্থাপন যেটি মধ্যযুগের মানুষদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিল- কোন প্রকার ক্রমাগত পরিবর্তন ছাড়াই- দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত। এটিই আসলে সংস্কৃতির রাজ্য।
সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষণায় লোকসংগীত যেভাবে একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে তার আলোচনা
লোকসংগীত সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চায় একটি অনন্য দলিল। বাংলাদেশের লোকসংগীত গবেষণায় যে সকল গবেষকবৃন্দ কাজ করেছেন। তাদের প্রত্যেকের কাজের একটা অংশ জুড়ে রয়েছে লোকসংগীতের সঙ্গে যুক্ত সাংস্কৃতিক ইতিহাস। বাংলা একাডেমির ১৫ই এপ্রিল ১৯৯৩ সালের এক আলোচনায় ডক্টর আনোয়ারুল করীম বলেন, ‘‘বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত আমাদের জাতিতত্ত্বের ইতিহাস। বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত বাংলাদেশের মানুুষের জীবনদর্শন। এই লোকসঙ্গীতের মধ্যেই আমাদের জাতীয় পরিচয় চিহ্ন রয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমি আমাদের লোকসঙ্গীত। এই লোকসঙ্গীতের মধ্যে আমাদের সংস্কৃতির যে রূপায়ণ দেখি তা একান্ত করেই মিশ্র সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই নিজস্ব সম্পদ।
আমাদের লোকসঙ্গীত পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই আমরা এ দেশের মানুষের মনের গতিবিধি, তার আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবধারার পারস্পারিক সম্পর্ক তুলে ধরতে পারবো। নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ রীতির মাধ্যমে আমাদের লোকসঙ্গীতের বিকাশ ও বিস্তারের পটভূমি আলোচনা অতীব প্রয়োজন। লোকসঙ্গীতের বিশ্লেষণে নৃবিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়ন জাতি হিসাবে আমাদের অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা দেবে। কারণ লোকসঙ্গীতই আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ইতিহাস এবং বর্তমানের আমাদের চেতনা ও ধ্যান-ধারণার সুস্পষ্ট নির্দেশক।’’
ডক্টর আনোয়ারুল করীমের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায় যে, লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গবেষণা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে ভাওয়াইয়া গানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ভাওয়াইয়া গান আদিবাসী রাজবংশীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। ইতিহাসপাঠে আমরা জানি উত্তরবঙ্গে এবং সিলেট অঞ্চলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ছিল। সিলেটে সুফি সাধনার প্রভাব ব্যাপক থাকায় সিলেটের যে সমস্ত বাউল গান পাওয়া যায় তা সুফি প্রভাবিত, যদিও বৈষ্ণব আশ্রিত পদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। রংপুর অঞ্চলেও বাউল শব্দের মতো ভাওয়াইয়া গানেও রাধা কৃষ্ণ, কানাই এবং চৈতন্য লৌকিক চেতনা নির্দেশক। তবে সব ভাওয়াইয়া গান দেহতত্ত্বমূলক এমন বলা যাবে না। ভাওয়াইয়া গান রাজবংশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম বিকাশ লাভ করলেও তা রংপুর দিনাজপুরের নিন্ম শ্রেণির সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সঙ্গীতের উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাদের ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ জীবনযাত্রায় সুখ-দুঃখ, এতদঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, এর আঞ্চলিক ভাষা সব কিছু ভাওয়াইয়ার মধ্যে রূপ পেয়েছে। বলা যেতে পারে এতদঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতির সার্থক রূপায়ণ ভাওয়াইয়া গান। এই ভাওয়াইয়া গানকে বিশ্লেষণ করেই আমরা রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার কাজটি করতে পারি। সিলেটের বাউল গানকে দিয়ে সিলেট অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে পারি।
সমাজ-সচেতনতামূলক লোকসঙ্গীতের অনুপম নিদর্শন রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা গান। গম্ভীরা গানে সমাজের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ব্যঙ্গাত্মকভাবে অথবা তির্যক ভঙ্গিতে হাস্যরস পরিবেশনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। পশ্চিমবাংলার মালদহ অঞ্চলের গম্ভীরা গানে হিন্দু দেবতা শিব বা ভোলানাথের বন্দনার মাধ্যমে সমাজের দুষ্কর্মগুলো কৌশলে তির্যক ভঙ্গিতে জনগণের সমক্ষে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে সুফি মাস্টার নামে জনৈক সঙ্গীতশিল্পী গম্ভীরা গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এতদঞ্চলের আলকাপ গান গম্ভীরা গানের ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ। এখানে বলা প্রয়োজন যে হিন্দু ধর্মের দেবতা শিবকে একজন প্রতিবাদী দেবতা এবং অন্যান্য শ্রেণির মানুষের রক্ষাকারী হিসেবে মান্য করা হয়। এই জন্য গম্ভীরা গানে নির্যাতিত মানুষের আপনজন হিসেবে শিবের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশে শিবকে ভোলা নানা কিংবা শুধুই ‘নানা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। নানা ও নাতির সঙ্গে রসের সম্পর্ক এবং এই সম্পর্কের মাধ্যমে অথবা আবরণে সমাজের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং স্থানিক সমস্যাগুলি ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরা হয়।
যেমন: নানা হে ভোলা নানা
কাম কাজ না করিলে মান রহে না
দেখ দুই দিন যদি বসে থাকি
কেউতো খেতে কহে না
নানা হে
আর যদি শ্বশুর বাড়ি যাই
দুই দিন আদরে খাওয়ায়
তিন দিনের বেলাতে শ্বশুর করে দেবে বিদায়
নানা হে করে দেবে বিদায়।।
গম্ভীরা গান চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক লোকসঙ্গীত হলেও বর্তমানে এই চর্চার প্রসার বাড়ছে। নানান ধরনের বেসরকারি কোম্পানির পণ্যের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সরকারি সচেতনামূলক প্রচারণার কাজে এই লোকসঙ্গীতের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে এর জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চল। বাংলার ইতিহাসে প্রাচীন এ জনপদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ফোকলোরের বিপুল ও বিচিত্র উপাদানের দিক দিয়েও এ অঞ্চল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সামাজিক ও ভূ-প্রকৃতির বিন্যাস, নদ-নদী ও জলবৃষ্টির প্রভাব, জনবসতির ধরণ ও বৈশিষ্ট্য এবং লোকসমাজের আচার, বিশ্বাস, সংস্কার, ঐতিহ্য, নিরন্তর পরিবর্তনশীল মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক গঠনের বৃহৎ পরিমণ্ডলের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এখানকার বিচিত্র, বহুমাত্রিক এবং অভ্যন্তরীণ গতিশীলতায় ঋদ্ধ ফোকলোরের উপাদান সমূহ।
ফোকলোরে সমৃদ্ধ বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচলিত এক শ্রেণির লোকসঙ্গীতের নাম ‘আলকাপ’। গ্রাম্য গাঁথা, উপকাহিনী ও বিভিন্ন সামাজিক বিষয়বস্তু নিয়ে আলকাপ গান রচিত হয়। আলকাপে কখনও কখনও দেব-দেবী তথা পুরাণের কথা আসলেও এ গানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রধান চরিত্র মানুষ, গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষ। এ গান সাম্প্রদায়িক কলুষমুক্ত।
আলকাপের উদ্ভব সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আলকাপের উৎপত্তি গম্ভীরা থেকে। আবার অনেকের মতে গম্ভীরা থেকে আলকাপের উৎপত্তি নয়, আলকাপ থেকেই গম্ভীরার উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ বলেন, মনসার ভাসান ও সত্যপীরের গান থেকে এ গানের উৎপত্তি। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে আলকাপের সঙ্গে রাঢ় অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ঝুমুর গানের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার খেউড় গানের সঙ্গেও আলকাপের সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। তবে পণ্ডিতদের কেউই তাঁদের লেখায় কোথা থেকে আলকাপের উদ্ভব তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। এই ক্ষয়িষ্ণু লোকসঙ্গীত নিয়ে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে উচ্চতর কোন গবেষণা এ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। তাই মধ্যযুগীয় সঙ্গীতরূপী আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসূত এ গানের প্রকৃত ইতিহাস আমাদের অজানাই রয়ে গেছে।
আলকাপের রচয়িতারা যেমন ভাবুক, রোমান্টিক তেমনি বাস্তববাদী গণকবি। মাটির পৃথিবীতে তাঁরা চোখ খুলে পথ চলেন, তাই তাঁদের বক্তব্যে ব্যক্তিগত প্রেম-ভালবাসা, হাসি-কান্না ও ব্যথা-বেদনার কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে সমাজের সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডুকতা কথা। আলকাপের রচয়িতারা অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত হলেও তাঁদের ভাবের গভীরতা, ভাষা প্রয়োগ কৌশল ও বুদ্ধি প্রয়োগ নৈপুন্য দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। আলকাপের সাহিত্যমূল্যও যথেষ্ট রয়েছে। আলকাপ গানের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক আমরা আলকাপ, গম্ভীরা কিংবা ঝাণ্ডি গানের উৎপত্তি ও বিকাশের পথ পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই।
উপরি উক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষণায় লোকসংগীত একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। কারণ লোকসঙ্গীত একটি অঞ্চলের অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত, একটি ছাড়ার অন্যটি বোঝা খুব সহজ সাধ্য বিষয় হয় না।
 

লেখক: জাফর জয়নাল, jafourjkkniu@gmail.com