চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ > আওয়ামী লীগের এতো ভোট গেল কোথায়?

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ সদর আসনে জনগন সরাসরি ভোট দিয়েছিলেন ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। মাঝে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে আব্দুল ওদুদ ১ লাখ ১২ হাজার ৮০২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর দশ বছর পর তিনি পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৯৩৮ ভোট। আবার এই দশ বছরের মধ্যে জামায়াত বিএনপি থেকে প্রায় ১৪/১৫ হাজার নেতাকর্মীকে দলে ভিড়িয়েছিলেন আব্দুল ওদুদ। এতো নেতাকর্মীর দলে যোগ দেয়ার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক নতুন ভোটার যুক্ত হবার পরেও দশ বছরে নৌকার ভোট কমেছে ২৬ হাজার ৮৬৪। এই বিপুল পরিমাণ ভোট কমে যাবার কারণ কি? তাই নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনে চলছে নানামূখি জল্পনা কল্পনা। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা, প্রার্থীর অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস, দলীয় কোন্দল, জামায়াত বিএনপি থেকে দলে আসাদের প্রাধন্য দেয়াসহ নবীন-প্রবীণদের সমন্বয়হীনতাকে দায়ি করলেও খোদ পরাজিত প্রার্থী দায়ি করছেন পুলিশের ভুমিকাকে।
র্দীঘ ৩৫ বছর আওয়ামী লীগের বেদখলে থাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনটি দখলে নেয়ার পর ১০ বছরের মাথায় আবারও বিএনপির ঘরে চলে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে সভা করেছে দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। দলীয় প্রার্থী আব্দুল ওদুদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় দলীয় প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ্ব বক্তব্য রাখেন।
দলীয় সূত্র জানায়, সভায় দলীয় কোন্দল, নির্বাচন পরিচালনায় সমন্বয়হীনতা, পুরাতন আওয়ামী লীগ বনাম নতুন আওয়ামী লীগের মধ্যে মনোস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব, ‘হাইব্রিড’দের অধিক গুরুত্ব দেয়াকে পরাজয়ের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন নেতৃবৃন্দ্ব। তবে, নৌকার প্রার্থী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ বলেন, ‘দলের মধ্যে কারো প্রতি আমার অভিযোগ নেই। আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচন করেছি, ৮৬ হাজার ভোট পেয়েছি এটিই আমাদের বিজয়’। তিনি বলেন, ‘ নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় আমরা পিছিয়ে ছিলাম না। তবে, সরকারি দলের কর্মীরা একটু অলস হয়। আর ক্ষমতা পাব এমনটা মনে করে বিরোধী দলে থাকা কর্মীরা চাঙ্গা থাকে। সরকারি দলের হিসেবে আমাদের কর্মীদের একআধটু অলসা ছিল’।
তিনি জয়ী হতে না পারার পেছনে জামায়াতের ভোট ধানের শীষে চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এখানে আমরা তিন দল (আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত) ভোট করলে আমরাই জিততাম। কিন্তু তারা (বিএনপি-জামায়াত) ভোটের শেষ দিকে এক হয়ে যায়। তারা শেষের দিকে এক হয়ে যাওয়াতেই আমরা বেকায়দায় পড়ে যায়’। এর বাইরে পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘দলীয় নেতৃবৃন্দ্ব পরাজনের কারণ হিসেবে উন্নয়নের মূল্যায়ন না করা, দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিছু নেতাদের নৌকার বিপক্ষে কাজ করার কথা বললেও আমি মনে করি পরাজয়ের মূল কারণ পুলিশের অসহযোগিতা ও হয়রানী। পুলিশের দ্বারা নেতাকর্মীরা হয়রানী হলেও আমি পুলিশী হয়ারনী বন্ধ করতে ব্যার্থ হয়েছি’।
দলীয় সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে প্রার্থী উপস্থিত থাকায় প্রার্থীর কর্মকান্ড নিয়ে অনেক নেতাই মন খুলে কথা বলতে পারেন নি। ওই সভায় উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘ সভায় আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা হাইব্রীডদের ভোট নিয়ে কথা বলতে চাইলে সভার অন্য এক নেতা ‘একথা আগে বলেননি কেন’ বলে তাকে থামিয়ে দেন’। ওই নেতা বলেন, ‘নির্বাচনে খোদ প্রার্থী জয়ের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে ‘গাছাড়াভাবে’ নির্বাচন করেছেন। নির্বাচনী খরচ নিয়ে পুরো নির্বাচনী এলাকার নেতাদের মধ্যে ছিল অসন্তোষ’। ওই সূত্র জানায়, নির্বাচনের দিন ১৫০ কেন্দ্রের প্রতিটিতে বরাদ্দ দেয়া ৮ হাজার টাকা নিয়ে মাঠের নেতারা এজেন্ট ও রিক্সা খরচ মেটাতেই হীমসীম খান।
এদিকে, ২০০৮ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আব্দুল ওদুদ স্থানীয় বিএনপি জামায়াতের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে দলে যোগদান করান। আব্দুল ওদুদের নেতৃত্বে অন্তত পাঁচটি বড় যোগদান অনুষ্ঠান হয়েছে। শহীদ সাটু হলে দু’টি, শিল্পকলা একাডেমিতে একটি এবং অপর দু’টি রানিহাটি মুক্ত মঞ্চে ও বারঘরিয়া দৃষ্টি নন্দন পার্কে। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী এর সংখ্যা প্রায় ১৪/১৫ হাজার। যোগদানকারীদের মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হচ্ছেন, সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জামায়াত মাওলানা সোহরাব আলী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মিজানুর রহমান, বারঘরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, জামায়াত নেতা তরিকুল ইসলাম সিদ্দীকি নয়ন, জুলমাত আলী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র বিএনপি নেতা সাইদুর রহমান, বিএনপি নেতা মাসিদুল হক মাসুদ, খসরু মিয়া, আলমগীর কবির, এজাবুল হক বুলি, কবির মেম্বার প্রমুখ। সর্বশেষ নির্বাচনের আগমূর্হুতে যোগ দেন, বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম রফিক। এদিকে, বিপুল সংখ্যাক বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীর দলে যোগদানের বাইরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তসিকুল ইসলাম তসি ও দুলাল আলী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার পরেও নৌকা প্রতিকের পথসভায় যোগদিয়ে বক্তব্য রেখে নৌকার জন্য ভোট চেয়েছেন।
আওয়ামী লীগে এতো বিশাল পরিমাণ বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মী যুক্ত হবার পরও ফলাফল কাংখিত নয় কেন পৌর আওয়ামী লীগের একনেতাকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘তাইতো ভাই, এতো ভোট গেল কোথায়?’।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ০৭-০১-১৯

,