নিয়মে না এলে পুরষ্কার মেলে!

সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনা, সমস্যা, সম্ভাবনা কিংবা পারিবারিক জীবন থেকে রাষ্টীয় জীবনের বিষয়গুলো নিয়ে ‘মানুষে মানুষে’ আলোচনা মানুষের জীবনেরই অংশ। এই আলোচনা বা কথা বলা বাঙ্গালির আদিকালের ঐতিহ্য। আমরা নাকি, ‘বেশি কথা বলি’। হ্যাঁ, বেশি কিনা জানিনা আমাদের অঞ্চলে আলোচনা করাকে মানুষ তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে অপরিহার্য হিসেবেই রাখেন এবং তাদের ব্যাপকহারে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখা যায়। হউক সেটা পুরুষ কিংবা মহিলা। হাটে বাজারের চায়ের দোকানে ‘চায়ের কাপে ঝড়’ তোলেন পুরুষরা। আর গ্রামাঞ্চলে পুকুরঘাটে মেয়েরা কথা বলতে বলতে ঘন্টা পার করে দেন। আর কাঁথা সেলাই করতে করতে কথা বলাটা না হয় বাদই রাখলাম। এই আলোচনাগুলো সাধারণত দেখা যায় ‘সমকক্ষ’ মানুষে মানুষে হয়ে থাকে। ‘সমকক্ষ’-এর বাইরে কেউ ওই আলোচনায় থাকলেও তাদের তেমন কথা বলতে দেখা যায়না। যদি না আবার ‘উচুকক্ষ’-এর লোক বলে বসেন ‘ছোটমুখে বড়কথা’। আমাদের সমাজে মানুষ তার শ্রেণী, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে তার জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই আলোচনা করেন, করেন সমালোচনা। সেখানে তার মত উত্থাপন করেন। এমনকি আলোচ্য বিষয়টির তার বিবেচনায় ইতিবাচক দিক বাস্তবায়নের দাবিও তোলেন। সহজভাবে বলতে গেলে, পথের ধারের চায়ের দোকানে বসে যে মানুষগুলো তাদের জীবনের যে যে অংশগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রেষ্টুরেন্টে নিশ্চয় তেমনটা হয়না। আমাদের সমাজ জীবনে এই আলোচনা বা কথা বলার গুরুত্ব রয়েছে। রয়েছে ইতিবাচক দিকও। কথা বলতে হবে, সমাজের সংগতি-অসংগতিগুলোকে নিয়ে। আর আলোচনায় বেড়িয়ে আসা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। তাতে দেশ, সমাজ তথা মানুষেরই কল্যাণ হবে।
এরকম এক আলোচনায় পরিচিত একজন একদিন বলছিলেন, ‘ভাই বাতেন খাঁ’র মোড়ে (চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের একটি মোড়) পুলিশ মটর সাইকেল ধরছে। আমি দ্রুত চালিয়ে চলে এসেছি। কিচ্ছু বলেনি’। নিবন্ধনহীন মটর সাইকেল চালানো ওই পরিচিতজনকে বললাম, ‘তুমি দ্রুত চালিয়ে না আসলেও তোমাকে কিছু বলতেননা’। সেসহ আলোচনায় থাকা অন্যরা কথাটা শুনে একটু আশ্চার্যই হল। প্রশ্ন করল, মানে? বললাম, তুমি নিবন্ধন ছাড়াই মটর সাইকেল চালাও। তার মানে তুমি সাহসি এবং ‘ক্ষমতাবান’। তোমার হাতে নেতা আছে, কিংবা আছে এমপি/মন্ত্রী। ওই ‘ক্ষমতাবান’ বলেই বুক ফুলিয়ে নিবন্ধন ছাড়াই মটর সাইকেল চালাচ্ছো। এটা তারা (দ্বায়িত্বপালনকারীরা) বুঝে নিয়েই তোমাদের তেমনটা আইনের আওতায় আনছেননা। ব্যাপরটা মনে হয় এমন যে, তারা মানে করেন এদের ধরলেই ঝামেলা’। 
আসলে এমটা যে সবসময় ঘটে তা নয়। ‘বিশেষ অভিযানে’ চিত্রটা থাকে ভিন্ন। যদিও ওই ‘বিশেষ অভিযান’ ক্ষমতাবানদের প্রভাবমুক্ত কতখানি থাকে তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন আছে। তুবুও সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ‘বিশেষ অভিযানে’ আমরা দেখেছি বহু নিবন্ধনহীন মটর সাইকেল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আটক করে সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়ে গেছেন। থানাগুলোকে তখন দেখা গেছে মটর সাইকেল ভর্তি থানা হিসেবে। ওই সময় আটক মটর সাইকেল নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর তার মালিককে তা দেয়া হয়েছে।
এই বিশেষ অভিযানকে যদি বাদ দেই তবে ‘বুক ফুলিয়ে’ চলার ওই দৃশ্যের সঙ্গে কেই দ্বিমত করবেন বলে আমার মনে হয়না। কারণ ওই দৃশ্য আমাদের চোখের সামনেই ঘটে। এমনটাতো দেখাও যায়, কোন মোড়ে মটর যানের অভিযান চলছে। দায়িত্বরত সদস্যরা একটি মটর যান থামালেন। গাড়ি চালকের কাছ থেকে নিবন্ধনের কাগজ দেখলেন। বললেন, ঠিক আছে। তারপর দেখতে চাইলেন, চালকের দক্ষতার ছাড়পত্র। সেটিও ঠিক আছে। অতপর প্রশ্ন বীমা করা আছে কিনা। নাই, দেয়া হলো মামলা বা অর্থদন্ড। এমনও দেখা গেছে, একটি মটর যান থামালেন। গাড়ি চালকের কাছ থেকে নিবন্ধনের কাগজ দেখলেন, তা ঠিক আছে। তারপর দেখতে চাইলেন, চালকের দক্ষতার ছাড়পত্র। সেটিও ঠিক আছে। অতপর জানতে চাইলেন বীমা করা আছে কিনা। সেটিও আছে। ও, আচ্ছা সেন্ডেল পায়ে মটর সাইকেল চালাচ্ছেন কেন? পায়ে জুতা কই... ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে সরকারিভাবে দেশজুড়ে অনিবন্ধিত মটর সাইকেলকে নিবন্ধনের আওয়তায় আনতে ২০১৫ সালের ৩ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেধে দেয়া হয়। ওই বেধে দেয়া সময়সীমাকে ঘিরেই শুরু হয় আইন প্রযোগকারী সংস্থার তৎপরতা একই সঙ্গে মটর সাইকেল মালিকরাও শুরু করেন তাদের মটর সাইকেল নিবন্ধন কাজ। ওই সময়সীমার মধ্যে বিপুল পরিমাণ মটর সাইকেল নিবন্ধন হয় ওই সময়ের নির্ধারিত সরকারি ফি দিয়ে। পরের চিত্র দেখুন, সরকারের বেধে দেয়া সময় সীমার মধ্যে ব্যাপক নিবন্ধন হওয়ার পর সরকারিভাবেই কমিয়ে দেয়া হল নিবন্ধন ফি। যারা সরকারের নির্দেশ তথা নিয়ম মেনে নিববন্ধন করলেন প্রায় ২১ হাজার টাকা দিয়ে ওই নির্দেশ বা নিয়মে যারা সামিল হলেন না তারা এখন তা করবেন ১২ হাজার টাকা দিয়ে (মটর সাইকেলে ইঞ্জিন ও ওজন ভেদে নিবন্ধন ফি’র তারতম্য রয়েছে)। 
মটর যান কিনলে রাষ্ট্রের নিয়মানুযায়ী তা নিবন্ধন করতে হবে। এই নিয়ম মানা লোকদের মুখোমুখি হতে হয় ‘সেন্ডেল কেন, পায়ে জুতা কই’ বিরম্বনার। আর নিয়ম না মানারা চললেন ওই ‘বুক ফুলিয়ে’। অবশ্য নওগাঁ পুলিশকে আমারা দেখেছি নিবন্ধিত মটর সাইকেল মালিকদের গোলাপ ফুল উপহার দিতে। তো একদিকে ঘটছে বিরম্বনা আবার টাকার অংক হিসেবে করলে দেখা যাচ্ছে নির্দেশ বা নিয়মকে অবজ্ঞা করলে সুযোগ মিলে কম টাকায় নিবন্ধন করার সুবিধা নামক পুরস্কার।
আমার ছাত্রজীবনের ঘটনা। কলেজের বেতন বাড়ি থেকে নেয়ার পর তা খরচ করে দিয়েছি। সামনে মাসে দু’মাসের বেতন একসঙ্গে দিয়ে দিব ভেবে চিন্তা করিনি। পরের মাসে বাড়ি থেকে বেশি টাকা নিয়ে কলেজে গিয়ে সেখান থেকেও আবার কিছু টাকা খরচ করে দিয়েছি। মনে মনে বলেছি, ‘নো টেনশন’ সামনে মাসে একসঙ্গে তিনমাসের বেতন দিয়ে দিব। এবার নানা কৌশলে বাড়ি থেকে তিনমাসের বেতনের সমান টাকা নিয়ে কোন খরচের পাশ দিয়ে না হেটে সোজা কলেজের অফিস সহকারী কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর বিষন্ন হয়ে ফিরে আসলাম। কারণ তিনমাসের বেতনের টাকার সঙ্গে জরিমানার যে পরিমাণ টাকা যোগ হয়েছে আমার প্যান্ট ও সার্ট মিলেয়ে থাকা ৫টি পকেট হাতরে ওই পরিমাণ টাকা বের করা গেলনা। পরলাম চারমাসের বকেয়ায়... সঙ্গে জরিমানাতো আছেই। সেখানে (কলেজে) ১০ মাসের বকেয়ার তালিকায় পড়া কাউকে ৬ মাসের বেতন নিয়েই সমন্বয় করার সুযোগ দেয়া হয়েছে এমনটা কেউ শুনেছেন কিনা জানিনা। তবে নিজ উদ্যোগে বেতন মওকুফের আবেদন করার কথা জানা গেলেও প্রতিষ্ঠানগতভাবে সুযোগ দেয়া হয়েছে এমনটা জানা নেই।
এবার আসা যাক একেবারেই সাম্প্রতিক বিষয়ে। দেশজুড়ে সিম নিয়ে চলছে সীমাহীন তৎপরতা। ঢাকার ফার্মগেটে ‘ডালিতে সাজিয়ে’ সিম বেচতে আর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গ্রামে, মহাল্লায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সিম বেচা-কেনা হতে আমরা অনেকেই দেখেছি। কাগজ পত্র, ছবি, টিপ কোন বালাই নেই বাঁ হাতে টাকা নিয়েছে আর ডান হাতে সিম দিয়েছে। আমরা দেশে চালু থাকা মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সিম আমরা কিনেছি তা নিশ্চয় ব্যবহারের জন্যে। আর তারাও সিম বেচেছে আমাদের ব্যবহার করতে দেয়ার জন্য। আমরা সিম কিনেছি তা ব্যবহার করতে হবে সেটাই নিময়। তো আমরা এই নিয়ম মেনে যারা সিম ব্যবহার করছি তারা ১জিবি ডাটা কিনতে যান। দেখবেন টাকাগুনতে হবে প্রায় সাড়ে তিন শ’ টাকা (আনুমানিক হিসেবে এবং কোম্পানী ভেদে তারতম্য আছে)। নিয়ম বর্হিভুতভাবে সিম ‘বন্ধ’ করে ড্রয়ার বন্দি বা কৌটা বন্দি করে রেখে দেন। দেখবেন, আপনার কাছে সুযোগ এসেছে মাত্র ৯ টাকায় ১ জিবি ডাটা। এমনকি মাত্র ৪৮ টাকায় ৮ জিবি ডাটা পাবার সুযোগও দিয়েছে সেবাদাতা কোম্পানীগুলো (একথাটিও আনুমানিক হিসেবে এবং কোম্পানী ভেদে তারতম্য আছে)। আর বন্ধ সিমে কথা বলার মূল্যহ্রাস অনেক সময় চালু রাখা সিমওয়ালাদের পস্তানার কারণ হয়ে যায়। এই বন্ধ সিম নিয়ে কোম্পানীগুলোর বাহারি বিজ্ঞাপন আমারা অনেকেই দেখেছি। ‘বন্ধ সিমে ফিরে আসা মানে যেন মায়ের বুকে ছেলের ফিরে আসা’ বিজ্ঞাপনগুলো এমনভাবেও উপস্থাপন করা হয়েছে। যা হোক বিজ্ঞাপনগুলো আমার বলা কথাগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
বলছিলাম, ডালিতে সিম সাজিয়ে বেচার কথা। এটিতো সত্যি। এমনটাইতো ঘটেছে অসংখ্য। আর সিমকে ঘিরে অনাকাংখিত ঘটনারও ঘটেছে বহু। ব্যক্তি জীবন, এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনেও হুমকীর মত ঘটনা আছে এই সিমকে ঘিরে। কাজেই সরকারকে সিন্ধান্ত নিতে হয়েছে, নামে বেনামে চালু থাকা সিমগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা। নিবন্ধনের নিময় আগেও ছিল। আগে যে প্রক্রিয়ায় সিম নিবন্ধন করা হতো সে প্রক্রিয়াকে অসৎ কাজে ব্যবহার করতে সিম বেচা হয় এমন দোকানে দোকানে ভুয়া আইডি কার্ড থাকতো। থাকতো প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ভুয়া সীলও। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্টুডিওগুলোর অব্যবহৃত ছবি রাখার খবরও ছিল আমাদের কাছে। কাজেই সরকার এবার শক্তভাবেই মাঠে নামেন। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় পরিচয় পত্র ও আঙ্গুলের ছাপ নিশ্চিত করে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া নিয়ে দেশজুড়ে নানান আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে। এমনকি উচ্চ আদালতে মামলাও হয়েছে।
তবে, যে যেভাবেই আলোচনা করেননা কেন। আমার বিবেচনায় এটা অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। একটা রাষ্ট্রে বা সমাজে থাকতে হলে অবশ্যই ‘শৃংখলা’ বা নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে।
সিমকে ‘শৃংখলায়’ আনতে সরকারিভাবে ৩০ এপ্রিল, ২০১৬ সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল। সরকারের এই ঘোষিত নিয়ম মানতে বহু মানুষ তাদের সিম নিবন্ধন করেছেন। শেষের দিকে নির্দিষ্ট কোম্পানীর ‘শো-রুমে’ দীর্ঘ লাইন ধরে আর গ্রামে গ্রামে নিমতলায়, বটতলায় সববেত হয়ে মানুষকে সিম নিবন্ধন করতে দেখা গেছে। সময়ের মধ্যে সিম নিবন্ধন করা নিয়ে মানুষের উৎকণ্ঠা’র শেষ ছিলনা। ৩০ এপ্রিলের শেষ মুর্হুতে কোম্পানীগুলো থেকে নাকি জানানো হয়েছিল যে, তাদের বহু সিম এখনও নিবন্ধনের আওতায় আসেনি। অতএব, সময় বাড়ানো হউক। বাড়ল একমাস সময়। এই বৃদ্ধি হওয়া একমাসকে ঘিরে দেখুন কোম্পানীগুলো কি পরিমাণ পুরস্কার দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। নিবন্ধন করলেই এয়ারটেল রবি ৫০ টাকা রিচার্জ। আর গ্রামীণ ফোনের রিচার্জেও পরিমাণ একলাফে ২০০ টাকা। প্রতি দু’ ঘন্টায় স্মার্ট ফোন, ১০ হাজার টাকা, ১ লাখ টাকা ইত্যাদি ইত্যদি। এমনকি রবি ও বাংলালিংক ঘোষণা করেছে মাস শেষে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার।
মটর যান নিবন্ধন বলেন আর সিম নিবন্ধন বলেন, যারা সরকারের প্রথম নির্দেশনা অনুসরণ করেন পুরস্কার তো যাওয়া উচিত তাদের দিকেই। কিন্তু সরকারের নিয়মমানতে যারা উৎকণ্ঠা নিয়ে সময়ের মধ্যে সিম নিবন্ধন করেছেন, ঝক্কিঝামেলা পোহিয়ে মটর যান নিবন্ধন করেছেন তাদের পুরস্কার তো নেই। নেই প্রসংশাও। অথচ নিময় অনুসরণ না করে এখন সিম নিবন্ধন করবেন তাদের জন্য শুধু পুরস্কার আর পুরস্কার। ‘বিচিত্র’ বলবো নাকি অন্য কোন শব্দ খুজবো...