আলতাদীঘির অজগর ভীতি আর জগদ্দল বৌদ্ধ বিহার ---------------------ফয়সাল মাহমুদ
ধামইরহাটে দুপুরের খাবার শেষে আবার রওনা হলাম। এবার ঠিকঠাক পৌঁছাতে হবে শালবনে অর্থাৎ আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানে। ‘আলতাদীঘি’ নামটা খুব পছন্দ হয়েছে আমাদের। ধামইরহাটে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে একটা ধারণা পেলাম পথ সম্পর্কে। শুনলাম সেখানকার প্রাণিকূলের কথাও। দুটি অজগর ছাড়া হয়েছে আলতাদীঘি উদ্যানে। যেগুলো লোকালয়ে চলে আসে। গত বছর প্রকাশ্য দিবালোকে একটি অজগর জ্যান্ত শেয়াল খাচ্ছে, এমন দৃশ্য দেখেছে আলতাদীঘিবাসী। শুনে গা ছম-ছম করে উঠলো। হাসতে হাসতে সুইট ভাই বললেন- আমি যাচ্ছিনা, এতোটা পথ পেরিয়ে অজগরের খাবার হতে চাইনা। আমরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। মাঝেমধ্যেই ধামইরহাটে ধরা পড়ে অজগর। ধরা পড়ে বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপও। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি অজগর ধরা পড়েছে ধামইরহাটে। এই লেখা যখন লিখছি তখনও (২৪ ফেব্র“য়ারি) বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ধামইরহাট উপজেলার জগতপুর গ্রামের নলপুকুর পাড় থেকে একটি অজগর ধরে গ্রামবাসী। এই গ্রামটি আলতাদীঘি উদ্যানের পাশের একটি গ্রাম। ১৬ কেজি ওজনের অজগরটি প্রায় সাড়ে সাত ফুট লম্বা। ওই গ্রামের নলপুকুর পাড়ে ঘোরা ফেরা করার সময় স্থানীয়রা দেখতে পায়। অজগরটি ভারত থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, বলেন ধামইরহাট বনবিট কর্মকর্তা লক্ষণ চন্দ্র ভৌমিক। গত ৭ ফেব্র“য়ারি একই উপজেলার দেবীপুর গ্রাম থেকে একটি অজগর শাবক উদ্ধার করে বন বিভাগ। ধামইরহাটে আটক অজগরগুলো ভারত থেকে আসে বলেই দাবি করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। আলতাদীঘি এলাকাটি একেবারেই ভারত সীমান্তঘেঁষা। সময়টা তখন দুপুর গড়িয়ে বিকালের দিকে। আমরা পৌছালাম আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানে। শালগাছের ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পিচঢালা পাকা সড়ক। কিছুদূর গিয়ে শুধু খোয়া বিছানো এবড়োথেবড়ো পথ। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আমরা পৌছালাম দীঘির পড়ে। এই দীঘিকে ঘিরেই জাতীয় উদ্যান। আলতাদীঘি নামের ওই দীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সুবিশাল বনভূমি। শালবন এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ২৬৪.১২ হেক্টর জমির এই বনভূমি। এর ঠিক মাঝখানেই প্রায় ৪৩ একর আয়তনের বিশাল একটি দীঘি। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে এটিকে 'আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান' হিসাবে ঘোষণা করে। জঙ্গলের গহিনে যাওয়া নিষেধ। সেই রকম কোন পথও নেই। দীঘির পূর্ব দিকে পাহাড় আকৃতির একটি জঙ্গল। আমরা সেটার কিছুদূর উঠলাম। এপার থেকে দীঘির ওপারের সৌন্দর্য টানলো আমাদের। মোটর সাইকেল নিয়েই দীঘির একপ্রাপ্ত ঘুরে গেলাম ওপারে। দীঘির তীর বেয়ে ঘুরে দেখলাম বনের সৌন্দর্য। সবাইকে অবাক করেছে এর সৌন্দর্য। সুইট ভাই বারবার বলছিলেন, পাশের জেলায় এত্ত সুন্দর একটা জায়গা আছে, আমার ধারনাই ছিলনা। আমাদের কারোর ধারনা ছিলনা। কিন্তু ‘সৌভাগ্য’ আমাদের, অজগরের দেখা মিলেনি। বানর-হনুমান কিছুই চোখে পড়লো না।
আমরা একদিনেই এতোটা ভয় পাচ্ছি, তাহলে এখানে বসবাসকারীদের কি অবস্থা। রাতের আঁধারে যদি অজগর হানা দেয় বাড়ি ঘরে! কয়েকমাস আগে দিয়েও ছিল তাই। বনে অবমুক্ত করা একটি বড় অজগর খাবারের সন্ধানে চলে আসে মঙ্গলকোঠা গ্রামের একটি বাড়িতে। অজগরসহ বন্যপ্রাণিগুলো আলতাদীঘি উদ্যন থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য গত বছরের শেষদিকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে স্থানীয় লোকজন। ওই মানবন্ধন থেকে দাবি তোলা হয়, আলতাদীঘি শালবন ও এর আশেপাশের প্রায় ১০টি গ্রামে আদিবাসী, হিন্দু, মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস। শুধু আলতাদীঘি শালবনের পাশে বাস করে প্রায় ৩ থেকে ৪শ ভূমিহীন পরিবার। এসব মানুষের কোনো ক্ষতি হয় কিনা সে বিষয়ে খেয়াল না রেখেই বন বিভাগ বনে দুটি অজগর সাপ অবমুক্ত করে। কিন্তু উন্মুক্ত বনে হিংস্র প্রাণিগুলো ছাড়ার পর থেকেই আশপাশের বাসিন্দারা ভীষণ আতংকে রয়েছেন। মানুষ ভয়ে বনের পথ দিয়ে চলতে পরছে না। অজগর আতংকে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতেও ভয় পায়। কিন্তু অজগরগুলো সরানো হয়নি। তবে বনে অবুমক্ত করা কিছু বানর ও হনুমান সরিয়ে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে নেয়া হয়েছে। আমরা সড়ক বেয়ে আসার সময় বিবর্ণ শালগাছ দেখেছি। কিছুদিন আগে থেকে পোকার আক্রমনে নষ্ট হয়ে বনের অনেক শালগাছ। ‘আঁচড়া’ পোকা নামে এক প্রজাতির পোকার আক্রমণে বনের অনেক গাছের গাছের ছাল-পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। গাছগুলো দেখলে মনে হবে আগুনে ঝলসে গেছে। পোকার আক্রমণে পুরনো গাছগুলো ছাল, পাতা, ফুল ও কুড়ি নষ্ট হয়ে মৃতপ্রায় আকৃতি ধারণ করছে। ছোট গাছগুলোর পাতা ও ডগাও খেয়ে ফেলছে পোকায়। পোকাগুলো দেখতে নাকি ধূসর রংয়ের ও এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বাকৃতির। গায়ে মৃদু কাঁটা আছে। এগুলোকে স্থানীয় বাসিন্দারা ‘আঁচড়া পোকা’ বলে থাকেন।
সুর্যটা ক্রমশ পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে। বসন্ত বিকালের মাতাল হাওয়া চারদিকে। এবার বন থেকে বিদায় নিতে হবে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জগদ্দল বিহার। আলতাদীঘি বন থেকে পাঁচ/ছয় কিলোমিটারের পথ। স্থানীয় একব্যাক্তি দেখানো পথ দিয়ে এগুতে লাগলাম। সীমান্তের নো-ম্যান্সল্যান্ডের খুব কাছাকাছি একটি গ্রামীণ সড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সড়ক থেকেই নোম্যান্সল্যান্ডের ওপারে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া দেখা যাচ্ছে। রাসেল ভাই সীমান্ত দেখতে চেয়েছিলেন। কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেল। মাঝে মাঝে রাসেল ভাইয়ের ইচ্ছাগুলো অবাক করে। অদ্ভুত বায়না তার। সীমান্তে দেখার কি এমন আছে, তবুও দেখবেন। আমরা এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের মজা করলাম। ধুলো-ধূসরিত মেঠোপথ। আমাদের মোটর সাইকেল সবার আগে। তাই খুব একটা ধুলো লাগেনি আমাদের গায়ে। কিন্তু যারা পেছনে ছিলেন, সারা শরীরে ধুলো মেখে সঙ সাজার মতোই অবস্থা। এই অবস্থাতেই আমরা পৌছালাম জগদ্দল বিহারে। জগদ্দল বিহার অতি প্রাচীন নিদর্শন। জনগণ এটিকে বটকৃষ্ণ রায় নামক এক জন জমিদারের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় রাজা রামপাল গৌড় রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর রামাবতী নগরে রাজধানী স্থাপন করেন। আইন-ই-আকবর রচয়িতা আবুল ফজল এ স্থানটিকে রমৌতি বলে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন বাংলার ধর্মমঙ্গল কাব্যগুলিতে রামাবতীর উল্লেখ আছে। রাজা রামপালের পুত্র মদনপালের তাম্র শাসনেও রামাবতী নগরীর উল্লেখ আছে। দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন, এই রামাবতী নগরে রাজা রামপাল জগদ্দল মহাবিহারের প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক রামপ্রাণগুপ্ত জগদ্দল বিহার দিনাজপুরে অবস্থিত বলে উল্লেখ করেছেন। রামপ্রাণগুপ্তের জগদ্দল বিহার যে নওগাঁ জেলার আলোচ্য বিহার তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ পূর্বে এ জেলা দিনাজপুর জেলার অংশ ছিল। একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা রামপাল এই মন্দির নির্মাণ করেন বলে নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে। কালের পরিক্রমায় বিহারটি ধ্বংস হয়ে যায়।
জগদ্দল বিহারের খননকাজ এখনো চলছে। এর আগে এই স্থান খনন করে ১২শ' থেকে ১৩শ' খ্রীষ্টাব্দের প্রচলিত বুদ্ধমূর্তিসহ বিভিন্ন প্রাচীন মূর্তি ও বহু বছরের পুরনো বিশাল আকারের কালো পাথর পাওয়া গেছে। খননের ফলে বেরিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটি কক্ষ, তিনটি বিশাল আকৃতির গ্রানাইট পাথরখণ্ড। পাওয়া গেছে গ্রানাইট পাথরে নির্মিত ১৬ ফুট স্তম্ভ। অলংকৃত বুদ্ধ মূর্তিসহ বেশ কিছু মূর্তি। পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরনের মৃৎ পাত্রের ভগ্নাংশ। নিদর্শনগুলো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জগদ্দল বিহারের আশপাশে বড় বড় বেশ কিছু মাটির ঢিবি রয়েছে। ঢিবিগুলোতে খনন কাজ চালালে আরো অনেক বুদ্ধমূর্তি, বিভিন্ন পাথরসহ অনেক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হতে পারে। দেশে এখন পর্যন্ত জগদ্দল বিহারেই সর্বাধিক সংখ্যক কালো ও গ্রানাইট পাথরের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
জগদ্দল বিহারের চারপাশটা ভাল করে ঘুরে দেখলাম। একেকজন একেক ভঙিতে ছবি তুলল। গ্রানাইট পাথরের উপর বসে একটি ছবি তুললাম আমি আর সুইট ভাই। যে ছবি এখন ফেসবুকে ঘুরছে। আমরা একটা দলীয় ছবি তুলতে চাই। কিন্তু ছয়জনই যদি লেন্সের সামনে দাঁড়াবে, তাহলে ক্যামেরার পেছনে থাকবে কে? দূর থেকে এক মধ্য বয়সী ব্যক্তিকে ডাকা হলো। সব বুঝিয়ে দিয়ে তাকেই দায়িত্ব দেয়া হলো আমাদের গ্র“প ছবি তোলার। তিনি ঠিকঠাকভাবেই দুটি ছবি তুলে দিয়েছিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল করলেন না লিটন ভাই। কৃতজ্ঞস্বরুপ তাঁর একটা ছবিও তোলা হলো। তিনি আমাদের আরো একটি ঐতিহাসিক নিদর্শনের সন্ধান দিলেন। ভীমের পান্টি। পৌরানিক কাহিনী অনুযায়ী, দেবদূত ভীম ভূমি চাষের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। গভীর রাতে চাষাবাদ শেষে মঙ্গলবাড়ীতে এসে ভোর হয়। তিনি দ্রুত লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়ার সময় তাঁর হাতে থাকা পান্টিটি মাটিতে পুঁতে যান। যেটিই এখন ভীমের পান্টি নামে নওগাঁ জেলার একটি দর্শণীয় স্থান। জগদ্দল বিহারের অদূরের ভীমের পান্টি। কিন্তু আমাদের সেখানে যাওয়া হয়নি। কারণ এরইমধ্যে আমাদের মনে ইচ্ছা জেগেছে, ভ্রমণ শেষ করবো দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার স্বপ্নপূরীতে। অথচ তখনো আমরা পড়ে আছি ধামইরহাট উপজেলায়। তাই আর সময় নষ্ট না করে রওনা হলাম।