স্বপ্নপূরীর স্বপ্নীল রাত --------ফয়সাল মাহমুদ

জগদ্দল বিহার যখন ছাড়ছি আমরা তখন সূর্য তার আলোর তেজ কমিয়ে পশ্চিম আকাশে আরো ঢলে পড়েছে। বসন্তের পড়ন্ত বিকেল। এই সময়টা সাংবাদিকদের কাটে কর্মক্ষেত্রেই। তাই মনে করতে পারছিলাম না, ইট-পাথরের শহর ছেড়ে শেষ কবে এমন একটি বিকেল কাটিয়েছি গ্রামের মেঠোপথে। ধূলোমাখা পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি পিচঢালা পথের খোঁজে। মূূল সড়ক থেকে আরো কয়েক কিলোমিটার ভেতরে আছি। গ্রামীণ সড়ক দিয়েই আমার গিয়ে উঠবো ধামইরহাট-জয়পুরহাট সড়কের কোন একখানে। গত বছর টালিউডের একটি সিনেমায় দেখেছিলাম। নায়ক জিৎ মোটর বাইকে ছুটে চলেছেন পথের পর পথ। মহাসড়ক থেকে মেঠোপথ, ছুটেই চলেছেন। তার গন্তব্যহীন ছুটে চলাটা ভালই লেগেছিল। পুরো সিনেমাজুড়েই তিনি খুঁজেছেন তার হারানো প্রেমিকাকে। আমরা ছুটে চলেছি বিনোদের খোঁজে। তবে এখন আর আমাদের যাত্রাকে গন্তব্যহীন বলা যাবেনা। কারণ এরইমধ্যে আমরা আমাদের গন্তব্য ঠিক করে নিয়েছি। আমরা থামব দিনাজপুরের স্বপ্নপূরীতে গিয়ে। রাতের স্বপ্নপূরী দেখা হয়নি আমাদের কারোর।
ধামইরহাট-জয়পুরহাট সড়ক দিয়ে আমরা গেলাম মঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত। ওইদিন মঙ্গলবাড়িতে হাট বসে। সড়কের উপরের বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে বসে আছে বিক্রেতারা। মঙ্গলবাড়িতেই আমার ধামাইরহাট-জয়পুরহাট সড়ক ছেড়ে শাখা সড়কে ঢুকতেই পড়লাম যানযটে। বাইক থেকে নেমে কিছুক্ষণের জন্য ট্রাফিকের দায়িত্বপালন করলাম। আমাদের তিনটি বাইকে কোন রকমে পার করে, আবারো ছুটে চলছি পাঁচবিবির দিকে। পাঁচবিবিতে বিকালের চা বিরতি আমাদের। দুটি মোটর সাইকেল সমগতিতে চললে একটি অনেক পেছনে পড়ে গেছে। একটা ফাঁকা মাঠে সেটার জন্য অপেক্ষা করছি। সড়কেই দুই ধারে সজিনা গাছের সারি। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে প্রতিটি সজিনা গাছের শাখা-প্রশাখা। ডালের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ ধানক্ষেতে ক্ষীণ আলো ছড়াতে ছড়াতে সূর্যটা জানান দিচ্ছে দিন শেষের। একটু দ্রুত গতিতেই আমরা পৌছালাম পাঁচবিবিতে। চা বিরতি শেষে আবারো ছুটে চলেছি। সড়কেই দুই ধারে সারি সারি গাছ। কোথায় দেবদারু তো কোথাও আবার ইউক্যালিপটাস। স্বাভাবিক ভাবেই চলছে বিভিন্ন যানবাহন। দেখে বোঝার উপায় নাই দেশজুড়ে চলছে ২০ দলের ডাকা অবরোধ। দ্রুতগতিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি হিলি স্থলবন্দরের দিকে। প্রথম ও দ্বিতীয় মোটর সাইকেলের সঙ্গে তৃতীয় মোটর সাইকেলের দূরত্ব বেড়েছে বেশ। ফোনে যোগাযোগের পর মনে হলো দূরত্বটা ৬/৭ কিলোমিটারের কম নয়। ততোক্ষণে গৌধুলীর আলো ছড়িয়ে অস্ত গেছে সূর্য। আমরা দূরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছি। প্রথম মোটর সাইকেলটি তখন আমিই চালাচ্ছি। পেছনে বসে আছেন সুইট ভাই। হিলি স্থলবন্দরের কাছে একটি ত্রি-মোহনীতে সুইট ভাই বললেন, ডান দিকে যেতে হবে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ডান দিকে যেতে লাগলাম। আমাদের অনুসরন করছে দ্বিতীয় বাইকটি। যেটির চালকের আসনে তখন মামুন। একের পর এক মাইল ফলক পার হচ্ছি। প্রায় ১০ কিলোমিটার পার হওয়ার পর পথ কেমন অচেনা অচেনা লাগছে। এর আগেও কয়েকবার ঘুরে গেছি হিলি স্থলবন্দর। সড়কের ধারে ছোট একটি বাজারে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম স্বপ্নপূরীর পথ। তিনি যা বললেন তা শুনে আমাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমরা ভুল পথে এসেছি। আমাদের দুটি বাইক ভুল পথে আসলেও তৃতীয় বাইকটি ঠিক পথেই আছে। যেটির ওই সময় চালাচ্ছিলেন রাসেল ভাই। তারা তখন হিলি-ফুলবাড়ি সড়কে। আর আমরা আছি হিলি-ঘোড়াঘাট সড়কে। একেবারেই বিপরীতমুখী দুটি পথ। ততোক্ষণে চারাদিকে রাতের অন্ধকার নেমেছে। ওই ব্যক্তি আমাদের একটি শাখা সড়ক দেখালেন। সেই সড়ক দিয়ে যাওয়ার যাবে দলারদর্গা নামক একটি স্থানে। সেখান থেকেই নবাবগঞ্জ যাওয়ার পথ মিলবে। অজানা ভয় নিয়েই আমরা যেতে শুরু করলাম সেই পথ দিয়ে। দুই দিকে কৃষি জমি আর মাঝ দিয়ে সড়ক। নির্জন সড়কে মাঝে মধ্যে দু/একটি যানবাহন দেখা যাচ্ছে। অচেনা এলাকার অচেনা পথ, অন্ধকারের মধ্যেই সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছি। ওই ব্যক্তি আমাদের বলেছিলেন, ৫/৬ কিলোমিটার পরেই দলারদর্গা। কিন্তু আমরা ৮/১০ কিলোমিটার পার হয়ে গেছি। কিন্তু দলারদর্গা পাচ্ছিনা। পথ বেড়েই চলেছে মনে হচ্ছে। অবশেষে পেলাম দলারদর্গা। ভেবেছিলাম এইবার বুঝি মুল সড়ক পাব কিন্তু না, আবারো শাখা সড়ক দিয়েই আমাদের পৌছাতে হবে নবাবগঞ্জ উপজেলা সদরে। রাত যতো বাড়ছে, আমাদের দুশ্চিন্তাও বাড়ছে ততো। তবে দুশ্চিন্তার মাঝেও আশার কথা, স্বপ্নপূরীতে থাকার জন্য আমরা রেস্টহাউস বুকিং করে রেখেছি। এই কাজে আমাদের সহযোগিতা করেছেন ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের দিনাজপুর প্রতিনিধি সালাহউদ্দীন ভাই। সালাহউদ্দীন ভাই বন্ধ হয়ে যাওয়া চ্যানেল ওয়ানের প্রতিনিধি ছিলেন। আমার নতুন হলেও সুইট ভাইয়ের পুরনো সহকর্মী তিনি। তাঁর মাধ্যমেই স্বপ্নপূরীর একটি রেষ্ট হাউস বুকিং করেছি।
দলারদর্গা থেকে নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর হয়ে আমরা রাত পৌণে ৯ টার দিকে স্বপ্নপূরীতে পৌছালাম। পরীর দুটি বিশাল আকৃতির প্রতিকৃতি আমাদের স্বাগত জানালো। ভেতরে প্রবেশ করে গেলে স্বপ্নপূরীর কার্যালয়ে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন দেলোয়ার ভাই। তিনিই স্বপ্নপূরীর মালিক। স্বপ্নপূরীর সবকিছুই তিনি নিজ হাতে করেছেন। স্বপ্নপুরী যে এলাকায় অবস্থিত সে এলাকার নাম আফতাবগঞ্জ। দেলোয়ার হোসেনের দাদার নাম আফতাব উদ্দীন। তাঁর নাম অনুসারেই এই এলাকার নাম আফতাবগঞ্জ। এই তথ্য অবশ্য আমাদের জানিয়েছেন স্বপ্নপূরীর এক কর্মকর্তা। রাতের স্বপ্নপূরী আমাদের পুলকিত করেছে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই দুশ্চিন্তা ঘিরে ফেললো আমাদের। সব পেছনের বাইকটি যেটি রাসেল ভাই চালাচ্ছিলেন, সেটি দুর্ঘটনায় পড়েছে। একটি ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে উল্টে যায় বাইকটি। এতে সামান্য আহত হন। এক পর্যায়ে তারাও পৌঁছালেন স্বপ্নপূরীতে।
আমাদের জন্য যে রেষ্টহাউসটি রাখা হয়েছিল, সেটি পছন্দ হলো না। স্বপ্নপূরীর এক কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে গেলেন ‘রংধনু গ্যালারী’ নামের আরেকটি রেস্ট হাউসে। দ্বিতীয় তলার কক্ষগুলো বেশ বড়। আমরা সেখানেই থাকবো। উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বিনোদন স্পটের রাতের সৌন্দর্য দেখব আমরা। দিনাজপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৫২ কিমি দক্ষিণে স্বপ্নপুরী অবস্থিত। একেবারেই ব্যক্তি উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে এটি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ষোল বছরের ব্যবধানে স্বপ্নপূরী এখন সত্যিই বিনোদনের স্বপ্নীল জগত। স্বপ্নপুরীর প্রবেশমুখেই আছে প্রস্তরনির্মিত ধবধবে সাদা দুটি পরী। পাখনা মেলে আছে। একহাত খালি থাকলেও আরেক হাতে আলো। তাদের পায়ের কাছেই তারকারা। শত তারার মাঝে দুটি পরী স্বাগত জানায় স্বপ্নপূরীর সকল আগতদের। ভিতরে ঢুকতেই ঝলমলে আলোয় চমকিত হবেন যে কেউ। সড়কের দুই ধারে বাহারী রঙের আলো পথ দেখাচ্ছে দর্শনার্থীদের। সড়কের পাশে হালকা আলোয় বিভিন্ন প্রতিকৃতি পেয়েছে আলাদা রুপ। প্রায় ১৫০ একর আয়তনের স্বপ্নপূরীতে সবুজের সমারোহের পাশাপাশি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ভাস্কর্য। সারিসারি সবুজ দেবদারু গাছের মনোলোভা সৌন্দর্য হাতছানি দিচ্ছে। সুগন্ধ ছড়াচ্ছে পথের ধারে ফুটন্ত ফুল। একেক পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মিলবে একেক ফুলের সুগন্ধ। রাত বাড়ছে, একে এক নিভছে স্বপ্নপূরীর আলো। ক্লান্ত শরীরে আমাদেরও বিশ্রামের যেতে হবে। তার আগে রাতের আড্ডা না হলে তো সফর পূর্ণতাই পাবেনা। আমাদের আড্ডায় নানা বিষয়েই যুক্তিতর্ক চলে। রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে। আমার সঙ্গে রাসেল ভাইয়ের তর্ক তুলনামূলক একটু বেশিই হয়। দুইজন দুই মতাদর্শের কারণে হতে পারে আবার দুইজনের মধ্যে বেশি সখ্যতার কারণেও হতে পারে। ওই রাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
আগের ভোরের মতোই ঘন কুয়াশায় পড়েছে। কুয়াশা আর ফোঁটায় ফোঁটার শিশির বিন্দু স্বপ্নপুরী সৌন্দর্য বাড়িয়ে আরো। আমরা ঘুরতে বের হলাম। মোটর সাইকেলেই ঘুরে দেখলাম পুরো স্বপ্নপূরী। নতুন অনেক কিছু সংযোজন হয়েছে এই বিনোদনস্পটে। দুটি আলাদা চিড়িয়াখান আছে। এরমধ্যে একটিকে আছে বিভিন্ন পশু-পাখির প্রতিকৃতি। আর একটিতে আছে জীবন্ত পশু-পাখি। শিশুদের জন্য আছে পার্ক। আছে নাগরদোলা, র‌্যাপিডকারসহ বিভিন্ন ধরনের রাইড। নতুন সংযোজন হয়েছে স্বপ্নপূরী নভোথিয়েটার। নভোথিয়েটারে ঢুকলাম আমরা। অ্যানিমেশন ও ধারাভাষ্যের মাধ্যমে গ্রহ-নক্ষত্ররাজি সম্পর্কে বিশদ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সকাল ১০ টা প্রায়। কিন্তু স্বপ্নপূরীতে নেই লোকজনের আনাগোনা। সাজানো-গোছানো স্বপ্নপূরী খাঁ খাঁ করছে। খুলেনি কোন দোকান। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা বাণিজ্যে কি ধরণের প্রভাব ফেলেছে, একটা স্বপ্নপূরী দেখলে যে কেউ সহজেই অনুমান করতে পারবেন। সূর্য্যরে তীব্র রোদ বিদায় ঘণ্টার মতো আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, যাবার সময় হয়েছে। আমাদের ফিরতে হবে। কেউ কেউ কিছুটা অতৃপ্ত। ফেরার পথে আমাদের পাহারপুর বৌদ্ধবিহার দেখার কথা ছিল। সময়ের অভাবে তা হয়নি। আরেকবারের জন্য বাকি রাখলাম পাহারপুরদর্শন। স্বপ্নপূরী থেকে হিলি-পাঁচবিবি-ধামইরহাট হয়ে পতœীতলায় এসে দুপুরের বিরতি। তারপর সরাইগাছি-রহনপুর হয়ে নিজ শহরে ফিরলাম। পুরো সফরজুড়ে আমাদের দুটি উপলব্ধি- ১. চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়ে পাশ্ববর্তী তিনজেলা নওগাঁ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের সড়ক ব্যবস্থা উন্নত। ২. ওই তিন জেলায় বন বিভাগ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে বনায়নের জন্য। কারণ সরাইগাছীর পর আমরা একটি সড়কও পাইনি যেখানে সড়কের দুই ধারের গাছ নেই। লাখ লাখ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছায়া দিয়ে যাচ্ছে পথিকদের। পুরো ভ্রমণে আমরা প্রিয় বন্ধুবর রাইহান আলীর অভাব খুব অনুভব করেছি। ব্যক্তিগত কারণে ইচ্ছা থাকার পরও আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন নি তিনি। চিকিৎসার জন্য ভারতে থাকায় মনোয়ার হোসেন জুয়েল ও তার সঙ্গে থাকার কারণে সাখাওয়াত জামিল দোলনও যেতে পারেন নি আমাদের সঙ্গে। অনিবার্যতায় তাদের ছাড়ায় আমাদের সফর। যেটার খুব প্রয়োজন অনুভব করছিলাম আমরা। মাত্র দুই দিনের সফর আমাদের আমাদের ভুলিয়েছিল প্রতিদিনের কাজের চাপ, ঝামেলা। সমৃদ্ধ করেছে অভিজ্ঞতা ঝুলি। স্ফিত করেছে মুক্তচিন্তার ভবিষ্যত পথ। তাই শেষবাক্যে এতটুকু বলি- স্মৃতি হয়ে থাকুক এই সফর, স্মৃতিতে থাকুক এবারের একুশে ফেব্র“য়ারি।