একুশের আলোয় জেগে উঠুক প্রাণ -------------মনোয়ারা খাতুন

প্রায় দুইশ’ বছরের ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটেছিল ১৯৪৭-এ। নানা আন্দোলন আর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বৃটিশ বেনিয়াদের শাসন আর শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয় ভারতবর্ষ। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটায় গোটা উপ মহাদেশ জুড়ে আনন্দের জোয়ার বইলেও পূর্ব বাংলার জনমনে স্বস্তি নেমে আসেনি। কেননা যে ধর্মকে পুঁজি করে সে সময় উদ্ভব ঘটেছিল পাকিস্তান নামক অদ্ভুত রাষ্ট্রটির, তার দুটি অংশের মধ্যে হাজার মাইলের ব্যবধান ছাড়াও ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত বিশাল ব্যবধান। সে সাথে যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণও নির্যাতন।
কোন মানুষই তার জাতিসত্ত্বা বদলাতে পারেনা। কেননা এটি তার জন্মগত অধিকার। বাঙালি জাতিও পারেনি তার ভাষার  উপর অধিকার হননের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে। ১৯৪৮ এর মার্চে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান, কার্জন হলের সমাবর্তন এবং পাকিস্তান বেতারে যে সব বক্তৃতা করেন তাঁর প্রতিটিতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ইঙ্গিত ছিল। এই বক্তৃতা পূর্ববাংলার জনমনে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে সমগ্র পূর্ববাংলা। বাংলার আপামর জনসাধারণ ততদিনে বুঝে গেছে, যে স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নতুন রাষ্ট্র ,এখনই রুখে না দাঁড়ালে সমস্ত অর্জনই হবে ধূলিস্যাৎ। তাই ৫২’র ২১ ফেব্র“য়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ছাত্র জনতার রাজপথে নেমে আসতে এত টুকু সময় লাগেনি। সেদিন অগণতান্ত্রিক পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের গুলির আঘাতে প্রাণ যায় নিরস্ত্র প্রতিবাদী বাঙালির। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। পৃথিবীর ইতিহাসে যুক্ত হয় ভাষার দাবিতে আত্মত্যাগের এক নতুন কাহিনী। সেদিন ভাষার দাবিতে বাঙালি তরুণেরা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করলেও, এর অন্তরালে থেকে যাওয়া পুঞ্জিভূত ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় স্বাধিকার আন্দোলনের। কেবল মাতৃভাষার সাথে মানুষের অটুট বন্ধনই পারে এমন গণজাগরণ তৈরি করতে। আর সেই গণজাগরণের পথ ধরেই সূচিত হয় ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ। একুশের স্মৃতিতে গড়ে ওঠা শহীদ মিনার সেদিন খুলে দিয়েছিল সম্ভাবনার দরজা। কেননা বায়ান্ন’র একুশ, সেদিন সকল অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই ও সাংস্কৃতিক জাগরণের শুভসূচনা করেছিল। একুশ আজ তাই বাঙালি জাতির প্রেরণার প্রতীক। সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় জীবনের সকল শুভ ও অশুভ ক্ষণে আমরা একত্রিত হই শহীদ মিনারে। যে কোন অর্জনে একুশ যেমন আমাদের প্রেরণা দেয়, তেমনি সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মানসিক শক্তি যোগায়।
বিশ্ব জুড়ে আজ বসবাস করছে কয়েক কোটি বাঙালি। ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্র“য়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান লাভ করেছে। বাঙালির জীবনে একুশ যুক্ত করে নতুন মাত্রা। বিশ্ব জুড়ে যখন এই দিনটি পালন করা হয় তখন বাঙালির গর্বের শেষ থাকেনা। একুশ এসেছিল বলেই আজ আমরা পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখ, বই মেলা -এমন সব দিনগুলিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতে পারি। উজ্জীবিত হতে পারি যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যদিও বর্তমান সময়টা আমদের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। আমাদের একথা মনে রাখা দরকার যে, জাতির কল্যাণ কামনায় অবশ্যই আমাদের মানবতাবাদী হতে হবে। তবে একথা সত্য যে, জাতি হিসেবে বাঙালিদের ভয় স্পর্শ করে না কখনোই। সকল অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার অদম্য সাহস ও শক্তি আছে বাঙালির। যে জাতি ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগে কুণ্ঠিত হয় না সে জাতি কোন অপশক্তির কাছে মাথা নোয়াবে না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বাঙালির রয়েছে রক্তক্ষয়ী গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আজও বাঙালির প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, সালাম, বরকত, মতিউর, জাহাঙ্গীরের মত বীরেরা। বাঙালির আছে আকাশ ভরা নক্ষত্র। বাঙালির চেতনায় আজও জ্বলজ্বল করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, সুফিয়া কামাল, জীবনানন্দের মত নক্ষত্ররা। তাঁদের গেয়ে যাওয়া জীবনের জয়গান আজ ও কোটি বাঙালির প্রেরণার উৎস। তাই সময় এসেছে সেই চেতনায়  নব উদ্যোমে জেগে উঠবার। যে বাঙালি নিজের বোধ-বুদ্ধির বিবেচনায় মেরুদন্ডকে সর্বদা সমুন্নত রেখেছে, সে কেন আজ বসে থাকবে। রাজনৈতিক সহিংসতা, অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার সময় এসেছে আজ। সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদের করালগ্রাসও কাবু করতে পারেনি বাঙালিকে। বাঙালি চিরকালই মোকাবেলা করতে জানে শত্র“কে। হতাশা থেকে বেরিয়ে এসে আত্মসম্মান নিয়ে জেগে ওঠার এখনই সময়। আজ জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে একুশের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। একুশ দেবে নতুন করে জেগে উঠবার প্রেরণা।

মনোয়ারা খাতুন-সদস্য সচিব, জাগো নারী বহ্নিশিখা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।