খরচটি বাঁচানো গেলনা
ক’দিন আগে দুপুরের পর একটা অপরিচিত সেল নম্বর থেকে ফোন আসলো। অলক দা’ বলছেন? উত্তর দিলাম হ্যাঁ বলছি। তিনি বললেন, ভাই আপনার কাছে একটা দরকারে এসেছি। আমি এখন আপনার অফিসের সামনে। আমি জানতে চাইলাম কি কাজ ভাই? তিনি তখন জানালেন, আমার ছেলে হারিয়ে গেছে। একটু পেপারের তা দেয়ার জন্য এসেছি আপনার কাছে। লোকটার ফোন কল গ্রহণ করার পর থেকেই মনে হচ্ছিল ভদ্রলোকের কথা ‘জড়িযে’ যাচ্ছে। যখন ছেলে হারানোর কথা শুনলাম। তখন ভাবলাম সন্তান হারানো পিতার কণ্ঠতো জাড়াবেই। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই থানায় জিডি করেছেন? তিনি বললেন, নাতো। আমি বললাম, পেপার-টেপার ছাড়েন আপনার প্রথম কাজ ছেলের বর্ণনা দিয়ে থানায় জিডি করা।সম্ভবত সেদিন ছিল ৩ ফেব্রুয়ারি। মাঝখানে ঘটনাটা ভুলেই গেছিলাম।
গেল ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর দেড়টার দিকে আমার অফিসে ৪৮ কিংবা ৫০ বছর বয়সী একজন বিদ্ধস্ত লোক আমার নাম ধরে আমাকে খোজার চেষ্টা করছেন। তখন আমার সহকমী রয়েল আমাকে দেখিয়ে দিতেই লোকটি আমার সামনে আসলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখে বয়স্ক মানুষদের মত চশমা। বেশ উস্কোখুস্কো। ফুল প্যান্ট আর সার্ট তার উপর হাফ হাতা সোয়েটার। প্যান্ট, সার্ট, সোয়েটার বেশী দিন ব্যবহার হলে যা ধরণের ‘ময়লা’ হয় তার ছাপ ষ্পষ্ট। তিনি ক্ষীণস্বরে বললেন, ভাই আপনাকে ফোন করেছিলাম। আমার হারানো ছেলেটার ব্যাপারে পেপার করার জন্য।বিদ্ধস্ত ও মলিন চেহারায় কথা বলা লোকটিকে দেখে বললাম, ওহ আপনি। আচ্ছা জিডি করেছেন? তিনি হ্যাঁ সুচক ঘারনেড়ে ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করলেন। সেটি জিডির কাগজ। একেবারে অস্পষ্ট। সেখান থেকে ঘটনা উদ্ধার (জানা) করা কঠিন। কাগজটি রেখে দিয়ে তার কাছে ঘটনাটি শুনতে চাইলাম। তাতে তিনি যেমনটা জানালেন যে, তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুর মিয়াপাড়া গ্রামে। তার ১৫ বছরের শিশু সন্তান রেজওয়ান গেল ২৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জ গেছিল রাজমিস্ত্রির কাজে।কিন্তু সেখানে তাকে কাজে লাগানো হয়নি, ফেরত পাঠানো হয়েছিল। রেজওযানের সঙ্গে যে ছেলেটি গেছিলো সে বাড়ি ফিরে এসেছে কিন্তু রেজওয়ান ফিরে আসেনি। বলেই লোকটি ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
নিরবতা সেই সঙ্গে ভাবনা ঘিরে ধরলো। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কি লাভ হবে? আর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া মানেতো (বিল) টাকা। একেতো বিপদগ্রস্থ লোক, তারপর আবার টাকা খরচ। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যদি ছেলেকে না পাওয়া যায়। এসব ভাবনার মাঝে করুণস্বরে শুনলাম, যে কোন উসিলায় হাঁর ছ্যাইল্যা হাঁরকাছে ফির্যা আসুক জি ভাই।ছ্যাইল্যাটার ল্যাইগ্যা ছটপট করছি। পূর্বথেকে ধারনা অনুযায়ী তাকে জানালাম আমি যে কাগজে কাজ করি (তাকে কাগজের নাম জানিয়েছিলাম) তাতে রঙ্গিন বিজ্ঞপ্তি ছাপতে খরচ হবে ১২ শ টাকা এবং সাদাকালো ৮শ টাকা। তিনি আমার কথা শুনে তার পকেট থেকে বেশ কয়েকটা একশ টাকা নোট বের করে গুনলেন। এবং আমার হাতে ১২ শ টাকা দেয়ার আগে ওই ১২ শ টাকা পরপর তিনবার গুনে দেখলেন। বারবার টাকা গোনা দেখেই পরিস্কার বোঝা যায় টাকা গুলো তার বহু কষ্টের। টাকাটা হাতে নিযে তাকে বললাম, পেপারে পরশুদিন বিজ্ঞপ্তিটা ছাপাই? নরম কণ্ঠেই তিনি জানতে চাইলেন, কেন? তাকে বললাম, ঘটনাটি আগে সংবাদ আকারে পাঠাবো। যদি সংবাদ আকারে ছাপাতে পারি তবে একটা টাকাও খরচ হবেনা। আর যদি না ছাপে তা হলে পরের দিন বিল দিয়ে বিজ্ঞপ্তি আকারে ছাপিয়ে দিব।দরিদ্র এই মানুষটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, দেখেন যেটা ভাল হয়। লোকটির যেন বিশ্বাস, পেপারে ছাপা মানেই তার সন্তানকে ফিরে পাওয়া। অবশ্য এমন আকুতিটাই স্বাভাবিক। দুপুরেই বন্ধু তরিকুল ইসলাম টুকু’র অফিসে গিয়ে সহকর্মী মেহেদী রেজওয়ানের ছবিটি স্ক্যান করে নিলো। তারপর সংবাদ আকারেই পাঠিয়ে দিলাম আমি যে কাগজে (দৈনিক পত্রিকায়) কাজ করি সেই কাগজে। পরের দিন ৬ ফেব্রুয়ারি হন্য হয়ে পাতা উল্টে খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম সংবাদটি। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। মনটা ভি-ষ-ণ খারাপ হলো। দুপুরে ফোন দিলাম পত্রিকার আমাদের বিভাগের প্রধানকে। বিষয়টা বললাম। তাকে এইও জানালাম যে, যেই লোক তার ১৫ বছরের শিশুকে রাজমিস্ত্রির কাজে পাঠায় সেই লোক কি স্বচ্ছল? সে কিভাবে ১২ শ টাকা খরচ করে বিজ্ঞপ্তি ছাপাবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ আপনি কালকে সেটা পাঠিয়েছিলেন। আমি বিষয়টি দেখছি। পরের দিন ৭ ফেব্রুয়ারি আবারও হন্য হয়ে পত্রিকার পাতায় সংবাদটি খুজে দেখার চেষ্টা
করলাম। কিন্তু সেদিনও পেলাম না। রেজওয়ান নামের কোন শব্দই দেখা মিললো না। দেখা মিলবে কেমন করে। যদি না ছাপা হযে থাকে। এরই মাঝে ওই দিন ভোরে রেজওয়ানের পিতা ফোন করে একদফা খোঁজ নিয়েছেন, বিজ্ঞপ্তিটা ছাপা হয়েছে কিনা। বাধ্য হয়ে বিজ্ঞাপন বিভাগের সহকর্মী জিয়াউল-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি জানালেন, নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছাপতে খরচ হবে এক হাজার টাকা যদি সেটি রঙ্গিন হয়। ম্যাটারটি পাঠিয়ে দেন শুক্রবার আমি অফিসে না গেলেও ছাপিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। দুপুরে বিজ্ঞাপন বিভাগে ম্যাটারটি পাঠিয়ে সন্ধ্যায়
জিয়াউলের বিকাশ এ্যাকাউন্টে এক হাজার টাকাও পাঠানো হলো। ৮ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় ( আমি যে কাগজে কাজ করি) রেজওয়ানের সংবাদও ছাপানো হয়েছে, বিজ্ঞপ্তিও ছাপানো হয়েছে…….