আমের ফলন ভালো, দামে বিপর্যয় — বিপাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চাষিরা



মাটি, আবহাওয়া ও প্রকৃতিগত কারণেই সুস্বাদু ও রসালো আম উৎপাদনের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের খ্যাতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই। দেশ বিভাগের আগে এই খ্যাতি ভারতের মালদহ জেলার থাকলেও পরে তা চলে আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘরে। সেই আমের রাজধানী চাঁপাইনবাগঞ্জের ‘আম অর্থনীতি’ এখন বেশ চাঙ্গা। ফলে এখন মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, এখানকার আম চাষী, আম ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। তবে এই চাঙ্গাভাবের মধ্যেও আমের দাম নিয়ে চাষিদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। 
এই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আমের বাম্পার ফলন হলেও আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় চিন্তিত আমচাষিরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪ টি আমের বাজারের মধ্যে জেলা শহরের পুরাতন আম বাজার, শিবগঞ্জে কানসাট, ভোলাহাট ও রহনপুর বাজারে এখন ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আম্রপালি, ফজলি, ব্যানানা ম্যাংগোসহ বিভিন্ন জাতের আম বিক্রি হচ্ছে। 
তবে চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার আমের মণ প্রতি ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা দাম  কম। অথচ সার, সেচ, শ্রমিক ও ওষুধের খরচ বেড়েছে। এতে উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না অনেকেই। আম চাষিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কৃষি বিভাগ বলছে এবার ঈদের লম্বা ছুটির মধ্যে দাম কিছুটা কম থাকলেও বতর্মানে ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। 
ফলন ভালো, দামে বিপর্যয়
চাষিরা বলছেন, চলতি বছর জেলায় অনুকূল আবহাওয়ায় আমের  ভালো ফলন হচ্ছে। ঈদের টানা ছুটি আর বৃষ্টির কারণে আম ঠিক সময়ে পাড়া যায়নি। একই সাথে খিরসাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলিসহ বিভিন্ন জাতের আম পেকে যাচ্ছে। এই কারণে এবার বাজারে আমের দাম কম। চাষিদের দাবি, উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারমূল্য এতটাই কম যে, অনেকেই জমি থেকে আম পাড়ার খরচ পর্যন্ত তুলতে পারছেন না।

আমের ৪ টি প্রধান বাজার
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ৪ টি প্রধান বাজারসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় অর্ধশত আমের বাজার রয়েছে। তবে এর মধ্যে দেশের বড় আমের বাজারটি বসে কানসাটে। বহুকাল আগেই গড়ে উঠেছে এ বাজারটি। জেলা সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কের কানসাট গোপালনগর মোড় থেকে কলাবাড়ী পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে আমের পাইকারী ও খুচরা কেনা বেচা। কানসাট আম বাজার এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় ৩ শতাধিক আমের আড়ত। এই বাজারে স্থানীয়সহ ঢাকার বিভিন্ন ফল ব্যবসায়িরা লম্বা সময় ধরে আম বণিজ্য করেন। 
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আমের বড় বাজারটি বসে পুরাতন বাজারে। মহানন্দা নদীর তীরে গড়ে উঠা প্রাচীন এই আমের বাজার এখন রমরমা। সদর গোবরাতলা, মহিপুর, বালিয়াডাঙ্গা, বারোঘরিয়া, মাহরাজপুর, কালিনগরসহ শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আমই এ বাজারের মূল যোগানদাতা।
অন্যদিকে জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরে বসে আরেক আমের বাজার। মহানন্দা আর পুর্নভবা নদী পথকে ঘিরে অর্ধ শতাব্দি আগে গড়ে উঠা রহনপুর আম বাজার এখন রমরমাভাব পেয়েছে বাজারকে ঘিরে সড়ক পথ যোগ হওয়ায়। রহনপুর রেল স্টেশনের সামনে এই আমের বাজার বসে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী উপজেলার ভোলাহাটেও বসছে আমের বড় বাজার। ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বসা এই আম বাজারের আড়তগুলো থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকাররা আম কিনে নিয়ে যান।
দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট বাজার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই কানসাট বাজার ও সড়কে শত শত রিকশাভ্যান গাড়িতে আম আনছেন আমচাষিরা।  কানসাট, মোবারকপুর, বাজিতপুর, গোমস্তাপুর চৌডালাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আমচাষিরা আম নিয়ে এসেছেন। ভ্যানের ওপর প্লাস্টিকের ক্যারেট ও বাঁশের ঝুড়িতে আম বোঝাই করে বাজারে আম আনা হয়। বিভিন্ন জেলায় আমের চালান দেয়ার জন্য প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান আসে কানসাটে। আম বাজারকে ঘিরে মূল সড়কে এক-দুই কিলোমিটারজুড়ে যানজট তৈরি হয়।
বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আমের ভরা মৌসুমে চাষি পর্যায়ে এবার আমের দাম বেশ কম। তাঁরা প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না। কারণ, ঈদের লম্বা ছুটি ।
আমের আড়তগুলোয় গিয়ে দেখা গেছে,  সকাল থেকেই আমচাষিদের নিয়ে আসা ভ্যানবোঝাই আম কিনছেন আড়তদারেরা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত চলে জমজমাট ব্যবসা। বিকেল হতেই বেচাকেনা কমতে থাকে।
কানসাট বাজারে আম নিয়ে আসা চাষি সুমন আলী খবরের কাগজকে বলেন, গত বছর আমের দাম ভালো পেলেও এ বছর দাম কম। কারণ, আমের ফলন বেশি, সেই সাথে এবার বৃষ্টির পরিমাণ বেশি। টানা বৃষ্টির করণে আম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মোকামে আম কিনছেনা।
সাগর নামে আরেক আম চাষি বলেন, ঈদে টানা ১০ দিন ছুটি ছিলো। ছুটির মধ্যে এক সাথে অনেক জাতের আম পেকে গেছে। সেই সঙ্গে ব্যাপারিরা আম কিনতে না আসায় আমের দাম পড়ে গেছে।
গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালার থেকে কানসাট বাজারে আসা আম চাষি আহসান হাবিব বলেন, ৩০ বছর ধরে কানসার বাজারে আম বিক্রি করি। এ বছর আমের দাম কম। বাজারে কোনো জুস কোম্পানির লোক আম কিনছেন না। তারা কম দামে আম কিনছে আড়তে। আমরা চাষিরা বাধ্য হয়ে কম দামে মোকামে আম দিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, গত বছরের থেকে এবছর মণে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা কমে আম বিক্রি হচ্ছে। এই দরে আম বেচে এবার চাষিদের বিষের (কীটনাশক) দাম উঠবেনা।
কানসাট আম বাজার পরিচালক আলমগীর জুয়েল বলেন, আমের ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ছোট বড় প্রায় ৫শ থেকে ৬ শ ট্রাকে আম ভর্তি হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্দেশে রওনা হয়। শুধু এই কানসাটেই প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ কোটি টাকার আম বেচা-কেনা হয়। ঈদের লম্বা ছুটির কারণে এবার চাষিরা আমের দাম কম পাচ্ছে।  বাজারে আমের সরবরাহ বেশি হলে দাম কম হয় আবার সরবরাহ কম থাকলে দাম বেশি হয়। তাছাড়া বিদেশে আম রপ্তানি  নাথাকায় তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে আম বাজারে। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, ‘বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ আম চাঁপাইনবাবগঞ্জেই উৎপাদন হয়। আমরা জানি, পুরো পৃথিবীতেই আম একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পণ্য। আমকে আমরা শিল্প পণ্য হিসেবে নিতে পারিনি। আমরা আম প্রকিয়াকরণ করছি না। প্রক্রিয়াকরণ করা হলে এখন যে বাজার মূল্য বলা হচ্ছে তা ৩ গুন বেড়ে যাবে। কর্মসংস্থান হবে, কৃষিপণ্যের অন্যান্য ব্যবহারগুলো বাড়বে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতি বড় হবে এবং জিডিপিতে অবদান রাখতে পারবো’।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, কুরবানির ঈদের আগেই আম সংগ্রহ শুরু হয়। ঈদের লম্বা ছুটি থাকার কারণে ওই সময় আম সংগ্রহ কম ছিল এবং ভোক্তাও কম ছিল। সেইজন্য আমের দামটা তুলনামুলকভাবে কম ছিল। এই মুহুর্তে পুরা দমে সংগ্রহ শুরু হয়েছে। দামও ভালো পাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় জাতসহ অনেক বাণিজ্যিক জাত রয়েছে। তবে জাত ভেদে আমের দাম কম বেশি রয়েছে। গ্রেডিং ও বাণিজ্যিক জাতগুলোর দাম বেশি, আশা করছি আগামি বছর বাণিজ্যিক জাতের আম বেশি উৎপাদন হবে। এই জাতভেদে আমের দামের পার্থক্য রয়েছে। 
তিনি আরো বলেন-‘চলতি মৌসুমের শুরুতে কিছুটা তাপদাহ বা খরা প্রবণতা ছিল। তবে, আমের বৃদ্ধি পর্যায়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় মাটিতে প্রচুর পরিমাণে রস আসে ফলে আমের বৃদ্ধিকালে আমের গঠন, বৃদ্ধি ভালো হয়েছে। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো। আশা করছি উৎপাদানের যে লক্ষ্যমাত্রা তার চেয়েও বেশি হবে’। তিনি বলেন-এবার এখন পর্যন্ত ৭০ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। 
এবছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ / নিজস্ব প্রতিবেদক / ০২ জুলাই ২০২৫