প্রাণঘাতি ‘জলাতঙ্ক’ রোগ- মানুষসহ গবাদিপশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং নিয়ন্ত্রণে করণীয় ---ডাঃ মোঃ আবুরেজা তালুকদার
জলাতঙ্ক রোগ মানুষ সহ স্তন্যপায়ী মেরুদন্ডী প্রাণির কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের (মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ড) একটি প্রাণনাশক জুনোটিক ডিজিজ। প্রধানতঃ বেওয়ারিশ ইনফেক্টেড বা নন-ইনফেক্টেড কুকুর, নন-ভ্যাক্সিনেটেড গৃহপালিত কুকুর, কিংবা বন্য মাংসাশী প্রাণি শিয়ালের কামড়ের মাধ্যমে দেশের সর্বত্রই বিপুল সংখ্যক গৃহপালিত গবাদিপশু সারাবছরই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয় প্রধানতঃ জলাতঙ্কগ্রস্থ পাগলা কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে। তবে কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজী, বানর ইত্যাদি প্রাণি এ রোগের রিজার্ভয়ার হোস্ট হওয়ায় উল্লেখিত নন-ইনফেক্টেড প্রাণির কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমেও মানুষ এ রোগ আক্রান্ত হতে পারে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এই প্রাণঘাতি রোগটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ চলমান কর্মসূচীর মাধ্যমে রোগটিকে এখনও একটি সন্তোসজনক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারেনি বিধায় এ দেশের মূল্যবান প্রাণিসম্পদ এবং মানব সম্পদ এখনও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে আছে। বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস-২০২২ এর যথাচিন্তিত প্রতিবাদ্য বিষয়টির (মৃত্যু আর নয়, সবার সাথে সমন্বয়) যথার্থতা উপলদ্ধি করার পর অনেকটা দ্বায়িত্ববোধ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েই ফিচারটি লিখতে বসে আমার অভিমত এভাবে ব্যক্ত করতে চাই যে, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে জনসাধারণকে জলাতঙ্ক রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত বা সচেতন করে তোলা সম্ভব হলে এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সমূহ (যেমন-প্রাণিসম্পদ বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, পাবলিক হেল্থ বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা) সহ পুলিশ বিভাগ যদি সমন্বিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়, তাহলে অদূরভবিষ্যতে এই প্রাণঘাতি জুনোটিক রোগটির আক্রমন থেকে তথা পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে অবধারিত, অনাকাঙ্খিত ও লজ্জাজনক মৃত্যুর হাতছানি থেকে এ দেশের মেধাবী মানবজাতি সহ মূল্যবান প্রাণিসম্পদকে অনেকাংশেই রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং বর্ণিত প্রতিবাদ্যটির যথার্থ মূল্যায়ন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
রোগের উৎপত্তি ও বিস্তার লাভের পদ্ধতি (প্যাথোজেনোসিস) ঃ জলাতঙ্ক বা র্যাবিসে আক্রান্ত কুকুর-শিয়াল-বিড়ালের মুখের লালাতে এ রোগের ভাইরাস (নিউরোট্রপিক র্যাবডোভাইরাস) বিদ্যমান থাকে এবং সুস্থ গবাদিপশুকে র্যাবিসে আক্রান্ত কুকুর বা শিয়াল এবং মানুষকে র্যাবিসে আক্রান্ত কুকুর-বিড়াল-গৃহপালিত পশু কামড়ালে লালাতে বিদ্যমান ভাইরাস প্রথমে দংশিত পশুর ক্ষতস্থানের মাংসপেশীতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং পরে নিউরো-মাসকুলার জাংশন অতিক্রম করে পেরিফেরাল নার্ভ ও স্পাইনাল কর্ডের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে এনসেফালোমায়েলাইটিসের সৃষ্টি করে (উল্লেখ্য যে, এনসেফালোমায়েলাইটিস সৃষ্টির মাধ্যমেই এ রোগের ক্লিনিক্যাল উপসর্গ প্রকাশ পায়)। অতঃপর মস্তিষ্ক থেকে ভাইরাসটি কতিপয় স্নায়ুর (ট্রাইজেমিনাল, গ্লসোফেরিঞ্জিয়াল, ফেসিয়াল, অলফ্যাক্টরি ইত্যাদি) অ্যাক্সনের মাধ্যমে স্যালাইভারি গ্ল্যান্ডে চলে আসে। প্রধানতঃ কামড়ের মাধ্যমে এ রোগ এক প্রাণি থেকে অন্য প্রাণিতে বা মানব শরীরে সংক্রমিত হয়ে থাকলেও দূর্লভ ক্ষেত্রে আক্রান্ত প্রাণির ভাইরাস-বহনকারী স্যালাইভা সুস্থ প্রাণির ফ্রেস-ওন্ডের সংষ্পর্শে আসলে সুস্থ প্রাণির দেহে এ রোগের সংক্রমন ঘটতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত প্রাণির ফ্যারিংস অবশ হয়ে যাওয়ায় খাদ্য ও পানি গলধঃকরণে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হয় এবং পানি বা জল দেখে খিঁচুনি বৃদ্ধিজনিত ভীতির সৃষ্টি হওয়ায় এ রোগকে বাংলায় ‘জলাতঙ্ক’ বলা হয়। এ রোগের সুপ্তিকাল সাধারনতঃ ১৫-৫০ দিন, তবে দূর্লভ ক্ষেত্রে সুপ্তিকাল কয়েক মাস পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে। উল্লেখ্য যে, মস্তিস্ক বা মাথার কাছাকাছি কামড়ালে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে এবং মাথা থেকে দূরবর্তী স্থানে কামড়ালে অপেক্ষাকৃত দেরিতে ক্লিনিক্যাল উপসর্গ প্রকাশ পায়। জলাতঙ্কগ্রস্থ পশুর দুধের মধ্যে এ রোগের ভাইরাস উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নির্গত হয় না বিধায় দংশিত পশুর দুধ পানের মাধ্যমে নবজাতক বাচ্চার কিংবা মানুষের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে, এ বিষয়টি নিয়ে অনেক সচেতন মানুষই ভীষণ কনফিউশনে ভুগে থাকে এবং টেনশনমুক্ত হতে ভেটেরিনারি চিকিৎসকদের স্মরণাপন্ন হন। এ রোগের কার্যকরী কোন চিকিৎসা না থাকায় ক্লিনিক্যাল উপসর্গ প্রকাশের পর শতভাগ আক্রান্ত মানুষ এবং আক্রান্ত পশুরই মৃত্যু হয়। মানুষের ক্ষেত্রে পোষ্ট-এক্সপোজার ম্যানেজমেন্ট এবং ক্লিনিক্যাল উপসর্গ গবাদিপশুর প্রায়ই অনুরুপ হলেও জলাতঙ্কগ্রস্থ মানুষের জীবনে এমন কষ্টদায়ক ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা দেখে যে কোন কোমলমতি মানুষই ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে। পুরাপুরি অবসাদগ্রস্থতা ও ক্ষুধামন্দা, অবিরাম লালাক্ষরণ, ভীষণ অস্থিরতা, আক্রমনাত্মকভাব ও কামড়ানোর প্রবণতা, ভগ্নকণ্ঠে কিছুক্ষণ পরপর চিৎকারশব্দ করা এবং রোগের শেষ পর্যায়ে শরীরের সমস্ত মাংসপেশী প্যারালাইজড্ হয়ে শতভাগ প্রাণিরই মৃত্যু হওয়া এ রোগের প্রধান ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য।
জলাতঙ্ক রোগের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ ঃ (১) ক্লিনিক্যাল রোগের শুরুতে আক্রান্ত পশুকে হঠাৎ করে খাদ্য ও পানি গ্রহণ বন্ধ করে দিয়ে সর্বদা শতর্ক ও দুশ্চিন্তাগ্রন্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, কান খাড়া ও চোখ বড় দেখায়, এবং অবিরাম লালাক্ষরণ শুরু হয়। (২) দুই-তিন দিন পর থেকে অস্থিরতা বা উত্তেজনা (আক্রান্ত ছাগলে অত্যধিক বেশি দেখা দেয়), আক্রমনাত্মক ভাব (ক্ষতস্থান, ও সম্মুখের যে কোন শক্ত বস্তুকে কামড়ানো, এবং মাথা দিয়ে মাটি বা শক্ত বস্তুর উপর চাপ দেওয়া), লালাক্ষরণ এবং ভগ্নকণ্ঠে জোরে জোরে চিৎকারডাক ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। (৩) ৪-৫ দিন পর আক্রান্ত পশুর উত্তেজনা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। এক পর্যায়ে শরীরের সমস্ত মাংসপেশী প্যারালাইজড্ (চলনে শক্তি-সামর্থহীন) হয়ে পড়ায় আক্রান্ত পশু মাটিতে স্থায়ীভাবে পড়ে যায় এবং নিস্তেজ ও অচেতন অবস্থায় যথাশীঘ্রই মৃত্যু হয়।
জলাতঙ্ক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ঃ (১) নন-ভ্যাক্সিনেটেড গৃহপালিত বা বেওয়ারিশ কুকুর কর্তৃক সুস্থ পশুকে কামড়ানোর ইতিহাস জেনে কিংবা চারণ ভুমিতে চরানো গরু বা ছাগলকে বন্য শিয়াল কর্তৃক কামড়ানোর ইতিহাস জেনে। (২) বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ক্লিনিক্যাল উপসর্গ দেখে (সম্পূর্ণ ক্ষুধামন্দা ও অবিরাম লালাক্ষরণ; বিরামহীন উত্তেজনা, আক্রমনাত্মক ভাব ও কামড়ানোর প্রবণতা; ভগ্নস¦রে কিছুক্ষণ পরপর ডাকাডাকি করা ইত্যাদি)। (৩) সন্দেহজনক কেসে (অর্থাৎ রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে হঠাৎ ক্ষুধামন্দা ও অবসাদগ্রস্থতা, শতর্কতা ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থতা এবং অবিরাম লালাক্ষরণ হতে দেখে) লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে রোগের উন্নতির পরিবর্তে তীব্রতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি সহ স্নায়ুবিক উপসর্গ তীব্রভাবে প্রকাশ পেতে দেখে। (৪) প্রভেদমূলক রোগ নির্ণয় করে ঃ (ক) র্যাবিস এবং সিউডোর্যাবিস রেগে প্রায়ই অনুরূপ ক্লিনিক্যাল উপসর্গ প্রকাশ পেলেও র্যাবিস রোগে শরীরে জ্বর ও চুলকানির সৃষ্টি হয় না কিন্তু সিউডোর্যাবিস রোগে শরীরে উচ্চ জ্বর সহ ভীষণ চুলকানি ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। (খ) ফুট এন্ড মাউথ ডিজিজে (ক্ষুরারোগে) আক্রান্ত গরুর দেহে উচ্চ জ্বর সহ অনবরত লালাক্ষরণ দেখা দিলেও (ওরাল মিউকোসাতে ক্ষত সৃষ্টি জনিত কারণে) দেহে স্নায়ুবিক উপসর্গ প্রকাশ পায়না কিন্তু র্যাবিস বা সিউডোর্যাবিসে অনবরত লালাক্ষরণ দেখা দিলেও ওরাল মিউকোসাতে কোন ক্ষত সৃষ্টি হয় না এবং স্নায়ুবিক উপসর্গ প্রকাশ পায়। কাজেই অনবরত লালাক্ষরণ, উচ্চ জ্বর এবং স্নায়ুবিক উপসর্গ দেখে জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, যেহেতু জলাতঙ্কগ্রস্থ রোমন্থক প্রাণির মুখের লালার মধ্যে র্যাবিস ভাইরাস বিদ্যমান থাকে, সে কারণে সন্দেহজনক কেসে আক্রান্ত পশুর মুখের মধ্যে কারণ বশতঃ হাত ঢুকানো থেকে শতভাগ বিরত থাকা অত্যাবশ্যক।
কুকুর বা শিয়াল গৃহপালিত পশুকে কামড়ালে করণীয় ঃ (১) দংশনকারী কুকুর বা শিয়াল পাগলা হউক বা নাই হউক, গবাদিপশুকে কামড়ালেই যথাশীঘ্র উপযুক্ত প্রাণি চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে এবং দংশিত পশুকে অবশ্যই মানসম্পন্ন প্রতিষেধক টিকা সিডিউল মোতাবেক প্রদান করতে হবে। কুকুর বা শিয়াল গৃহপালিত পশুকে কামড় দিলে যথাশীঘ্র ক্ষতস্থান কাপড় কাঁচার সাবান ও পর্যাপ্ত পানি দিয়ে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধুয়ে দিতে হবে এবং আক্রান্ত প্রাণিকে যথাশীঘ্র সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে নিয়ে গিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারি সার্জন কর্তৃক উপযুক্ত চিকিৎসা এবং রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অফিস টাইমের পরে কিংবা ছুটির দিনে কামড়ানোর ঘটনাটি সংঘটিত হলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হাঁতুড়ে ডাক্তার বা কবিরাজের শ্মরণাপন্ন না হয়ে সরকারী বা প্রাইভেট ভেটেরিনারি চিকিৎসকের সহিত ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে পোষ্ট-এক্সপোজার ম্যানেজমেন্টটি সম্পন্ন করে নিতে হবে। (২) দংশিত পশুকে ফুল কোর্স ভ্যাক্সিন প্রয়োগকালিন সময়ের মধ্যে বা ভ্যাক্সিন প্রদান শুরুর আগে পরিচর্যাকারী বা পরিবারের কোন সদস্যের হাতে দংশিত পশুর দাঁতের আঁচর বা কামড় লাগলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কবিরাজ, হাঁতুড়ে ডাক্তার বা পশু চিকিৎসকের নিকট গিয়ে অযথা কালক্ষেপণ না করে যথাশীঘ্র স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিসিন বিশিষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হতে হবে এবং বানিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত ও আমদানিকৃত মানসম্পন্ন উচ্চ-মূল্যমানের প্রতিষেধক টিকা (যেমন-র্যাবিপুর, ভেরোর্যাব ইত্যাদি) কোম্পানীর শিডিউল মোতাবেক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। (৩) দংশিত পশুকে বানিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত ও আমদানিকৃত মানসম্পন্ন প্রতিষেধক টিকা (যেমন-র্যাবিসিন, র্যাবিস ভ্যাক্সিন, নোভিব্যাক র্যাবিস ভ্যাক্সিন ইত্যাদি) অবশ্যই কোম্পানীর শিডিউল মোতাবেক প্রয়োগ করতে হবে এবং গুলানো ভ্যাক্সিন অবশ্যই ফ্রিজের নরমাল চেম্বারে ২-৮ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, ভ্যাক্সিন গুণগতমাণসম্পন্ন না হলে কিংবা সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষিত না হলে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না বরং দূর্লভ ক্ষেত্রে মারাত্মক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে জীবন বিপন্ন হতে পারে। শতর্কতামূলক এই তথ্যটি দংশিত পশুর মালিক বা পরিচর্যাকারীকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক কিংবা ভ্যাক্সিন বিক্রেতা কর্তৃক অবহিত হতে হবে।
নোট ঃ (ক) গবাদিপশু কিংবা মানুষকে র্যাবিস ভাইরাস বহনকারী বা র্যাবিসে আক্রান্ত কোন প্রাণি কমড়ালেই দংশিত গবাদিপশু কিংবা মানুষকে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধে মানসম্পন্ন প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। কিন্তু জলাতঙ্ক রোগের মানসম্পন্ন বিদেশী টিকা অধিক মূল্যমানের হওয়ায় এবং আমদানি নির্ভর হওয়ায় এ দেশের একটি বিশাল অংকের অর্থসম্পদ প্রতিনিয়তই বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই অর্থসম্পদ রক্ষার্থে জলাতঙ্ক রোগ সৃষ্টির মূল কারণ যথাশীঘ্র দূরীকরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (খ) পোষা কুকুর বসতবাড়ী পাহাড়া দিতে এবং ক্রিমিনাল ও নিষিদ্ধ বস্তু সনাক্তকরণে প্রশংসনীয় ভুমিকা পালন করে থাকলেও বেওয়ারিশ কুকুর জনকল্যাণকর কাজে কোন ভুমিকা রাখে না বরং টেপ-ওয়ার্মে আক্রান্ত কুকুরের মল দ্বারা দুষিত খাদ্যবস্তু বা ঘাস খেয়ে গবাদিপশু কতিপয় মারাত্মক কমন ডিজিজে যেমন-ছাগল গিড-ডিজিজে (মস্তিষ্কে ম্যাসিভ ক্ষত সৃষ্টিকারী রোগ), গরু হাইডাটিডোসিসে (নন-কিউরেবল্ নিউমোনিয়া এন্ড ইনডাইজেশন) এবং কুকুরের কামড়ের মাধ্যমে গবাদিপশু র্যাবিস রোগে আক্রান্ত হলে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে, এতে পশুপালনকারীর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়। (গ) বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা ও জলাতঙ্ক রোগের ব্যাপকতার কারণে ফরেন-এইড নির্ভরশীল এ দেশে জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণে মাচ্-ভ্যাক্সিনেশন এর চেয়ে মানবিক-কিলিং (ইউথ্যানেশিয়া) বেশি কার্যকর, সহজ পদ্ধতী ও সাশ্রয়ী। উল্লেখ্য যে, মাচ্-ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম পরিচালনাকালে কুকুর আতঙ্কিত ও সজাগ হয়ে যাওয়া একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন এলাকার ৫০% এর অধিক কুকুরকে ক্যাচিং এন্ড ভ্যাক্সিনেশন করা দুরুহ হয়ে পড়ে। এছাড়া ভ্যাক্সিনেটেড কুকুরের গলায় আইডেন্টিফিকেশন বেল্ট ব্যবহার করা না হলে কিংবা বেল্ট ব্যাবহার করলেও যথাসময়ে বুষ্টার ডোজ প্রয়োগ করা না হলে ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম ব্যার্থ হবে, কুকুর কর্তৃক দংশিত গবাদিপশু কিংবা মানুষকে পোষ্ট-এক্সপোজার দামী-নামি ভ্যাক্সিন ঠিকই গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া একটি বিশাল সংখ্যক বিড়ালকে ইমিউনাইজেশন এবং নিষ্ঠুর শেয়াল গোষ্ঠিকে নিধন কার্যক্রমের বাহিরে রেখে বাংলাদেশকে জলাতঙ্ক রোগ মুক্ত বা নিয়ন্ত্রিত ঘোষণা করা আদতে দুরুহ ব্যাপার। উল্লেখ্য যে, পোষা বিড়ালকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রি-এক্সপোজার ভ্যাক্সিন এবং লাইসেন্স প্রদান করে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ আগেই চারণ ভুমিতে চড়ান গবাদিপশুকে গৃহে ফিরিয়ে এনে নিষ্ঠুর শিয়ালের আক্রমন থেকে গ্রামিন কৃষকের গবাদিপশুকে অনেকাংশে রক্ষা করা যাবে। (ঘ) ভেটেরিনারি চিকিৎসক সহ গবাদিপশু চিকিৎসার সহিত সম্পৃক্ত নন-ভ্যাক্সিনেটেড ভেটেরিনারি কম্পাউন্ডার ও ড্রেসার সহ মাঠ-কর্মীদের অনেকটাই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে পোষ্ট-বাইটিং কেস ম্যানেজমেন্ট করতে হয়। এছাড়া দেশের সকল জেলা হাসপাতালে মানুষের জন্য বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও জেলা বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে পোষ্ট-এক্সপোজার র্যাবিস ভ্যাক্সিন সরবরাহের প্রোভিশন না থাকায় অনেক সময় অসভ্য ক্লায়েন্টগণ সংশ্লিষ্ট প্রাণি চিকিৎসকদের সহিত অহেতুক বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। সামর্থবান ক্লায়েন্টগণ ভ্যাক্সিন ক্রয় করতে সম্মত হলেও দরিদ্র ক্লায়েন্টগণ চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে কবিরাজের স্মরণাপন্ন হন এবং নিজেরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থেকে যান। উল্লেখ্য যে, স্বাস্থ্য বিভাগে জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচীর আওতায় জেলা সদর হাসপাতালে মানুষের জন্য বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা সরবরাহের ব্যবস্থা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যহত থাকার ফলশ্রুতিতে গবাদিপশুর চেয়ে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বর্তমানে তুলনামূলক কম। এ কারণে স্বাস্থ্য বভিাগরে সাথে তাল মলিয়িে গবাদিপশুর এই প্রাণঘাতি সংক্রামক রোগটি যথাশীঘ্র নিয়ন্ত্রণ করতে স্বাস্থ্য বিভাগের জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণ ষ্ট্র্যাটিজি অনুসরণ করে কিংবা সঠিক পরামর্শ নিয়ে প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পশুপালনকারীদের তথা দেশবাসীর মঙ্গল হবে। (ঙ) জনসচেতনতার ভীষণ অভাব, মানসম্পন্ন বিদেশী ভ্যাক্সিনের অধিক মূল্য ও স্থানীয় মার্কেটে অপ্রতুলতা, জেলা বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে পোষ্ট-এক্সপোজার র্যাবিস ভ্যাক্সিন বিনামূল্যে সরবরাহের প্রোভিশন না থাকা, গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত ও দরিদ্র কৃষকদের অনেকেরই সস্তা কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি অন্ধবিশ্বাস, গৃহপালিত বা বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়ালকে মাচ্-ভ্যাক্সিনেশন কিংবা বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়াল-শিয়াল নিধনের মাধ্যমে এদের সংখ্যা হ্রাসকরণের ফলঃপ্রসু কার্যক্রম চলমান না থাকা, ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নিয়মিত প্রচারণার ব্যবস্থা না থাকা কিংবা বিদ্যালয়ের উপরের শ্রেণীর পাঠ্য-পুস্তকে জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ না থাকা ইত্যাদি কারণে এই ভয়াবহ রোগটির প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ আপাততঃ দুরুহ ব্যাপার, তবে এ বছরের প্রতিবাদ্য বিষয়টিকে সামনে রেখে যুগান্তকারী কর্মসূচী গ্রহণ এবং একটি সন্তোসজনক পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে জলাতঙ্ক রোগ নিয়ে আতঙ্ক বা রোগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনমনে বিরাজমান হতাশা অনেকটাই কেটে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
জলাতঙ্ক রোগ দমন বা নিয়ন্ত্রণের উপায় ঃ (১) জলাতঙ্ক রোগের ক্লিনিক্যাল উপসর্গ প্রকাশের পর ঔষধীয় চিকিৎসা কিংবা প্রতিষেধক টিকা দিয়ে কোন লাভ হয় না বরং এ রোগে আক্রান্ত প্রাণির মৃত্যু অনিবার্য্য হয়ে পড়ে এবং রোগ বিস্তারের ঝুঁকি বা পরিবেশ তৈরী হয়। তবে গৃহপালিত পশুকে প্রি-এক্সপোজার ভ্যাক্সিন (যেমন-লেপ ভ্যাক্সিন এবং হেপ ভ্যাক্সিন, প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মহাখালি, ঢাকা কর্তৃক প্রস্তুতকৃত) বছরে একবার করে প্রদান করে ইমিউনাইজড্ করা যেতে পারে। হেপ ভ্যাক্সিন তিন মাসের বেশী বয়ষ্ক গরু, মহিষ ও বানরকে ৩ মিলি এবং এক মাসের বেশী বয়ষ্ক বিড়াল ও বেজীকে ১.৫ মিলি করে মাংসে প্রয়োগ করতে হয়। গরু ও মহিষকে ৩০ দিন পর বুষ্টার ডোজ দিতে হয়। লেপ ভ্যাক্সিন ৩ মাসের বেশী বয়ষ্ক কুকুরে ৩ মিলি মাংসে প্রয়োগ করতে হয়। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে সরকারী নির্ধারিত মূল্যে এই ভ্যাক্সিন পাওয়া যেতে পারে। (২) জলাতঙ্ক রোগের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ প্রকাশের পর আক্রান্ত প্রাণিকে নির্ঝঞ্ঝাট অন্ধকার ঘরে রাখতে হবে এবং গলায় ও পায়ে শিকল পড়িয়ে শক্ত-মজবুত খুঁটি বা গাছের সাথে বেঁধে রাখতে হবে। সন্দেহজনক ক্ষেত্রে আক্রান্ত পশুর মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে রোগ নির্ণয় কিংবা খাদ্য বা ঔষধ খাওয়ানো থেকে পরিচর্যাকারী, পরিবারের সদস্য এবং চিকিৎসককে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। সন্দেহজনক কেসে মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে রোগ নির্ণয় কিংবা খাদ্য বা ঔষধ খাওয়ানোর সময় পরিচর্যাকারী, পরিবারের কোন সদস্য কিংবা চিকিৎসকের হাতে কামড় বা দাঁতের আঁচড় লেগে ক্ষত সৃষ্টি হলে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধকল্পে সংশ্লিষ্ট পরিচর্যাকারী, পরিবারের সদস্য বা হাঁতুড়ে চিকিৎসককে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অযথা কালক্ষেপন না করে (আক্রান্ত পশুটি প্রকৃতই জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে কিনা কিংবা প্রতিষেধক টিকা নিতে হবে কিনা এই ভেবে) যথাশীঘ্র স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিসিন বিশিষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ফুল-কোর্স প্রতিষেধক টিকা নিতে হবে। উল্লেখ্য যে, থালা পড়া, পানি পড়া, গুড় পড়া, ঝাড়-ফুক, গাছ-গাছড়া ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধের কোন প্রমাণাদি বা রেকর্ড নাই। এজন্য কুকুর, শিয়াল বা বিড়াল কর্তৃক মানুষ কিংবা গৃহপালিত প্রাণি দংশিত হলে কোন অবস্থাতেই যেন কোন কবিরাজ কোনরুপ চিকিৎসা প্রদান না করেন সে বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং এ বিষয়ে জনগণকেও সচেতন করে তুলতে হবে। (৩) দুধের মাধ্যমে র্যাবিস ভাইরাস উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নির্গত হয় না বিধায় দংশিত পশুর দুধ খেয়ে নবজাতক বাচ্চা বা মানুষের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। তবে নবজাতক বাচ্চার ওরাল মিউকোসাকে বা পাকস্থলিতে আলসার থাকলে এবং ক্লিনিক্যালি আক্রান্ত গাভীর মুখের লালা দ্বারা ওলানের ও বাঁটের ত্বক কলুষিত হলে সেক্ষেত্রে বাঁট চুষে দুধ খাওয়ার মাধ্যমে নবজাতক এরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। এ কারণে প্রসুত গাভী বা ছাগী দংশিত হলেই বাচ্চাকে মায়ের বাঁট চুষে দুধ খাওয়ানো থেকে সম্পূর্ণ বিরত রেখে অন্য গরুর দুধ বা উন্নতমানের মিল্ক-রিপ্লেসার খাওয়ানো উত্তম হবে। (৪) রোগের বিস্তার প্রতিরোধে দংশনকারী বেওয়ারিশ কুকুরকে পাকড়াও করে মেরে ফেলে মাটির গভীরে পদ্ধতীগতভাবে পুঁতে ফেলতে হবে। অপরাগতায় পৌরকর্তৃপক্ষকে অবহিত করে সমস্যাটির সমাধান করে নিতে হবে। (৫) জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সমন্বিতভাবে কতিপয় যুগপোযাগী কার্যক্রম গ্রহণ ও উহার সফল বাস্তবায়ন করতে হবে ঃ (ক) প্রধানতঃ বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা একবারে কমিয়ে আনার ফলদায়ক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এজন্য ব্রিডিং মৌসুমে বা শীতের প্রাক্কালে দেশব্যাপি বেওয়ারিশ কুকুরকে মানবিকভাবে ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিধন করতে হবে এবং এই বিশাল কর্মকান্ডটি সফলভাবে বাস্তবায়নে প্রাণিসম্পদ বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, পাবলিক হেল্থ বিভাগ, এবং সিটি কর্পোরেশন বা পৌরকর্তৃপক্ষকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তবে ম্যাচ্-ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষে পর্যাপ্ত ফান্ড সংগ্রহ করা সম্ভব হলে প্রতিবছর ব্রিডিং পিরিয়ড বা শীতের প্রাক্কালে ৫০% কুকুরকে নিধন করে অবশিষ্ট কুকুরকে ইমিউনাইজড্ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও স্বাস্থ্যবিভাগের বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উত্তম হবে। উল্লেখ্য যে, বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হলে রোমন্থক পশুর জলাতঙ্ক রোগ সহ কতিপয় কমন মারাত্মক রোগ যেমন-ছাগলের ‘গিড ডিজিজ’ (সেনুরোসিস), গরুর হাইডাটিডোসিস ইত্যাদি সন্তোসজনক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এবং এভাবে সাধারন গবাদিপালনকারীদের মূল্যবান পশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির অনুকুল পরিবেশ তৈরী করে দেশের জনসাধারণের প্রাত্যহিক নিরাপদ আমিষের (দুধ ও মাংস) চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদ বিভাগ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে। দেশব্যাপি এই বিশাল কর্মকান্ড বাস্তবায়নের জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে একটি বিশাল বাজেটের প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। (খ) পোষা কুকুর-বিড়াল এবং গৃহপালিত গবাদিপশু পালনকারীদেরকে লাইসেন্স প্রদান করতে হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে তাদের পশুকে রুটিন মাফিক ইমিউনাইজড্ করতে (প্রি-এক্সপোজার ভ্যাক্সিনেশন) সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন ও কঠোর মনিটরিং এর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, স্কুল-কলেজে পড়ুয়া অনেক শিক্ষিত-ভদ্র পরিবারের টিনেজ ছেলে-মেয়েরা এবং সমাজের উচ্চস্তরের শিক্ষিত-ভদ্র মহিলারা সাধারনতঃ উন্নত জাতের কুকুর কিংবা বিড়ালকে অনেকটাই সখের বশবর্তী হয়ে লালন-পালন করে থাকে বিধায় তাহারা ভীষণভাবে স্বাস্থ্য-ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তবে কিছুটা আশার বাণি এই যে, জলাতঙ্ক রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে উক্ত রোগ প্রতিরোধকল্পে প্রি-এক্সপোজার ভ্যাক্সিনেশনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে এদের অনেকের মধ্যেই উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে ভেটেরিনারি চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়ার ক্রমবর্ধিঞ্চু প্রবণতা বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। (গ) উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে মানসম্পন্ন পোষ্ট-এক্সপোজার র্যাবিস ভ্যাক্সিন বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধে বা নিয়ন্ত্রণে প্রান্তিক পর্যায়ের পশুপালনকারী সহ সকল পর্যায়ের পশুপালনকারীদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। (ঘ) পৌরসভা সহ ইউনিয়ন ভিত্তিক আধুনিক কসাইখানা ও মাংস বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে নিরাপদ মাংস বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং জবেহকৃত পশুর বর্জ্য স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অপসারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সদ্ব্যবহার (জৈব-সার কিংবা পশু-পাখি-মাছের খাদ্য উৎপাদন) করে পরিবেশ দুষণ রোধ সহ কুকুর-শিয়ালের খাদ্য সংকট সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা পুষ্টির অভাবজনিত ইনফার্টিলিটি রোগে আক্রান্ত হয়ে গর্ভধারন বা বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। উপযুক্ত প্রাণি চিকিৎসক কিংবা অভিজ্ঞ মাঠকর্মী কর্তৃক জলাতঙ্ক রোগ ডিক্লিয়ার হওয়ার পর জলাতঙ্কে আক্রান্ত কোন গৃহপালিত পশুকে যেন কোন অবিবেচক কসাই বা আক্রান্ত পশুর মালিক রাতের অন্ধকারে জবাই করে মাংস বাজারে নির্বিঘ্নে বিক্রি করতে না পারে সে বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কঠোর আইন প্রণয়ন ও কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (ঙ) ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে কিংবা বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসে সর্বস্তরের গবাদিপশু ও ডোমেষ্টিক কুকুর-বিড়াল পালনকারী সহ জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রনকারী বিভাগের দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে সম্পৃক্ত করে দিনব্যাপি মুক্ত মঞ্চে প্রতিবাদ্য বিষয়টিকে সামনে রেখে জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে (রোগের কারণ ও বিস্তার, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ, রোগের প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয়ে অসুবিধা ও ঝুঁকি, পোষ্ট-বাইটিং ম্যানেজমেন্ট বা চিকিৎসা ব্যবস্থা, রোগের রিস্ক-ফ্যাক্টরস্ বা পরিণতি, রোগ নিয়ন্ত্রণে জটীলতা ইত্যাদি সম্পর্কে) জনসচেতনতা বৃদ্ধি সহ রোগ প্রতিরোধক বা নিয়ন্ত্রণমূলক আলোচনা করলে দেশব্যাপি প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক গবাদিপশু সহ সাধারন জনগনের অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
সর্বোপরি উন্নয়নশীল এ দেশে প্রাণঘাতি এই জলাতঙ্ক রোগ সহ অন্যান্য মারাত্মক সংক্রামক রোগের (যেমন- ইমার্জিং লাম্পি স্কিন ডিজিজ, অ্যানথ্রাক্স, ক্ষুরারোগ, বাদলা, গলাফোলা, পিপিআর ইত্যাদি) আক্রমন থেকে এ দেশের মূল্যবান প্রাণিসম্পদকে রক্ষার মাধ্যমে দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন জনগণের প্রাত্যহিক নিরাপদ আমিষের (দুধ ও মাংস) চাহিদা পূরণের মাধ্যমে এ দেশের মেধাবী জাতি গঠন ত্বরান্বিত হবে, অন্যদিকে অধিক পরিমাণে উৎপাদিত নিরাপদ আমিষ (রেড মিট) বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। আর এই বিশাল অর্জন বাস্তবায়ন করতে মাঠ পর্যায়ের খামারী সহ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ-প্রকল্প গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের ন্যায় প্রাণিসম্পদ বিভাগে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ‘সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা’ খুলে ‘জাতীয় সংক্রামক রোগ নির্মূল কর্মসূচী’ গ্রহণ ও উহার সফল বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
- লেখক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা