বিদেশী শিক্ষক পরিবারের সঙ্গে আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছাস


মিষ্টি রোদের শীতের সকাল-দুপুরের কয়কটি ঘন্টা আনন্দ-উচ্ছাসে ঝলমলে হয়ে উঠেছিল বাবুডাইং আদিবাসী আলোর পাঠশালার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যেমন, তেমনি পাঠশালায় বেড়াতে আসা বিদেশী শিক্ষক পরিবার ও সঙ্গে থাকা শিশুরাও একাত্ম হয়ে মেতেছিল আনন্দে। রোববার বরেন্দ্রর গহিনে অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রথম ট্রাস্ট পরিচালিত বাবুডাইং আদিবাসী আলোর পাঠশালায় ঘটে এমন আনন্দময় ঘটনা।
বাংলাদেশ ইকো এডভেঞ্চার নামের একটি পর্যটন কেন্দ্রিক একটি সংস্থা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ড নাগরিক শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের শিশু সদস্যদের বিদ্যলয় বেড়ানোর আয়োজন করে। সংস্থার প্রধান নির্বাহী মেহেদী হাসান বলেন, ঢাকার একটি আর্ন্তাতিক ইংরেজি স্কুলের শিক্ষকদের কাছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এ গ্রামটির বিদ্যালয় পরিদর্শনে আগ্রহ সৃষ্টি হয় এর আগে আসা একজন বিদেশী শিক্ষকের কাছ থেকে শুনে। এখানে বেড়ানো তাঁদের সার্থক হয়েছে প্রত্যাশারও বেশি। বড়ই আনন্দে কেটেছে বিদ্যালয়ের থাকার সময়টুকু। স্মৃতিতে অম্লান থাকার মত। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও বাঙালি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের প্যারেড-পিটি, শপথ ও জাতীয় সঙ্গীতে যেমন, তেমনি নাচে গানে ও কাসরুমে সক্রিয় আনন্দময় অংশগ্রহন দেখে এমনটাই মনে হয়েছে। সকাল ১০টার দিকে সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে প্রথমেই গ্রামে ঢোকে তিন শিশুসহ আটজনের এ দলটি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার একটি আন্তর্জাতিক স্কুলের পরিচালক নেদারল্যান্ডের থমাস ডেন ভার, তাঁর স্ত্রী পমিলি ও তাঁর তিন শিশু সন্তান, শিক্ষক যুক্তরাষ্ট্রের ইরেন উইলসন ও তাঁর মেয়ে এবং অন্য শিক্ষক ডেভিড চার্লস।  তাঁরা গ্রামের পুকুর, মাটির বাড়ি, ফুলের গাছ, গরু-বাছুর ও ছাগল-ছাগল ছানা, মাটির বাড়িতে অঙ্কিত আলপনা, মন্দির, গীর্জা ঘুরে উচ্ছসিত হয়। এসময় একটি বাড়ির মাটির দেয়ালে নববর্ষ উপলক্ষে এক শিক্ষার্থীকে আলপনা আঁকতে দেখে বিদেশী শিশুরাও তার সঙ্গে অংশ নেয়। এরপর বিদ্যালয়ের পথে ঢোল-মাদল বাজিয়ে নেচে-গেয়ে বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে যায় আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীরা। এসময় নিজেদের ভাষায় ঐতিহ্যবাহী গান গেয়ে মালা পরিয়ে বরণ করে কোল শিক্ষার্থীরা। এরপর অ্যাসেম্বলী, পিটি-প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। শপথ ও জাতীয় সংগীতের অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন অতিথিরা। পরে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান পরিবেশন করে শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষার্থীরা হাতের তালুতে আঙ্গুলের তালি দিয়ে বৃষ্টির ওঠা-নামার শব্দ শোনায়। এটি তাঁদের মুগ্ধ করে। নিজেরাও অনুশীলন করে শিখে ফেলে। এসময় বাংলাদেশে এসে শেখা ওড়িশি নৃত্য পরিবেশন করেন ইরেন উইলসন। তিনি স্কুলে নাচও শেখান। পরে অতিথিরা শ্রেণিকক্ষগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটান। এসময় ষষ্ঠ শ্রেণির কক্ষে গিয়ে ইংরেজি বই থেকে ‘লেটস প্লে’ কবিতাটি আবৃত্তি করে একজন শিক্ষার্থী। পরে থমাস ডেন ভারও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান, ‘স্কুল ইজ ওভার, ওহ, হোয়াট ফান! লেসন ফিনিসড, প্লে বিগান, হু উইল রান ফাস্টেস্ট, ইউ অর আই? হু উইল লাফ লাউডেস্ট? লেট আস ট্রাই।’ এসময় তাঁর এক শিশু কন্যা বাংলায় বলে ওঠে, আমি। শ্রেণিকক্ষে চলে কিছুক্ষণ হাসির ফোয়ারা। তাঁরা সকলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাব বিনিময় ও ফটো সেশন করেন। ফিরে যাওয়ার সময় মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
আলোর পাঠশালার নাচের দলের সদস্য সুরমিলা হাসদা বলে, বিদেশী অতিথিদের সঙ্গে আজকের সময়টা আমাদের খুব আনন্দে কাটলো। দিনটির কথা আমারেদ অনেকদিন মনে থাকবে।
অতিথিদের দেখতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভিড় করেন গ্রামের নারী-পুরুষরাও। উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কানাই চন্দ্র দাস, আলী উজ্জামান নূর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য জহিরুল ইসলাম, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ ইকো এডভেঞ্চারের সদস্য নাজিব ফেরদৌস প্রমূখ।
প্রধান শিক্ষক আলী উজ্জামান নূর বলেন, একটি আন্তর্জাতিক ইংরেজি স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা খুবই উৎফুল্ল হয়েছে। শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের শিশুরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশেছে। তাদের সঙ্গে পিটি-প্যারেড করেছে, জাতীয় সংগীতে অংশ নিয়েছে। শ্রেণিকক্ষে গিয়ে শিক্ষকরা যেভাবে ইংরেজি কবিতা শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাঠ করেছে তাতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আরও বেড়েছে। এছাড়া আমেরিকান শিক্ষক ইরেন উইলসনের ঐতিহ্যবাহী ওড়িশি নৃত্য দেখে আমাদের শিক্ষার্থীরা নাচ শিখতে আরও উদ্দমী হয়েছে। সবমিলিয়ে বাবুডাইং আদিবাসী আলোর পাঠশালার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে দিনটি ছিল একটি স্মরণীয় দিন। এসব বিদেশী বন্ধুদের আমাদের শিক্ষার্থীরা মনে রাখবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ০২ জানুয়ারি, ২০২২