তিনদিনের সুখের সংসারে কাল হলো বজ্রপাত> চলে গেল ১৬ প্রাণ


চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের পদ্মানদীর তেলিখাড়ি ঘাট এলাকায় বজ্রপাতে মর্মান্তিকভাবে ১৬ জন নিহত হয়েছে। বিয়ের তিনদিন পর বিশাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে বর কনেকে আনতে গিয়ে প্রাণ হারালেন তাঁরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাসে এটি প্রথম বজ্রপাতের ঘটনা যেখানে এক বজ্রপাতেই ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটলো। বজ্রপাতের ঘটনায় আহত আরো ১২ জন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যু সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। মর্মান্তিক এঘটনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সূর্যনারায়ণপুরজুড়ে চলছে শোকের মাতম।


শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব আল রাব্বী ও নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মমিনুল হক জানান, বুধবার সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সুর্যনারায়ণপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম পাচু তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে নতুন বউসহ ছেলেকে আনতে যাচ্ছিলেন শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের তেররশিয়া গ্রামে। দুর্গম চরাঞ্চলের সূর্যনারায়ণপুর থেকে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ জনের যাত্রীবাহি একটি নৌকাযোগে বিশাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে তেররশিয়া যাবার পথে পাকা ইউনিয়নের তেলিখাড়ি ঘাটের কাছে আসলে হটাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। দ্রæত নৌকাটি তীরে ভিড়িয়ে যাত্রীরা আশ্রয় নেয় ঘাটের উপরের একটি ঘরের মধ্যে। সেখানে বজ্রপাত হলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন যাত্রীদের ৩০ থেকে ৩২ জন। সেখানেই প্রাণ হারান ১৬ জন।
নিহতরা হচ্ছেন, পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকা তেররশিয়া গ্রামের মৃত সোহবুল হকের ছেলে রফিকুল ইসলাম (৬০), সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ডালপাড়ার সৈয়ব আলীর ছেলে তোবজুল (৭০), তোবজুলের স্ত্রী জমিলা (৫৮) ছেলে সাদল আলী (৩৫), জামালের মেয়ে লেচন (৫০), রফিকুলের ছেলে বাবলু (২৬), বাদলের ছেলে বাবু (২০) একই উপজেলার সূর্য নারায়ণপুরের ধুলু মিয়ার ছেলে সজীব (২২), সাহালাল বাবুর স্ত্রী মৌসুমী (২৫), কালুর ছেলে আলম (৪৮), মোস্তফার ছেলে পাতু (৪০), চর সূর্য নারায়ণপুরের টিপুর স্ত্রী বেবি (৩২) ফাটা পাড়ার গ্রামের সাদিকুলের স্ত্রী টকি বেগম (৩০), চর বাগডাঙ্গা গোঠাপাড়ার সাত্তারের ছেলে সহবুল (৩০), বাবুডাইং এলাকার মকবুলের ছেলে টিপু সুলতান (৪৫) ও সুন্দরপুর এলাকার সেরাজুলের ছেলে অসিকুল ইসলাম ডাকু (২৪)।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফারায় সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারি পরিচালক সাবেব আলী বলেন, ‘দুর্যোগপুর্ণ আবহাওয়ার মাঝে তারা দুর্ঘটনার শিকার হলে আমাদের খবর দেয়া হয়। খবর পেয়ে শিবগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস দ্রæত ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করি। ১৪ থেকে ১৫ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসাপাতালে পাঠায় আর ১৬ জনকে নিহত অবস্থায় উদ্ধার করি। নিহতদের কয়েকজনের মরদেহ তাদের পরিবারের লোকজন নিয়ে বাকীদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের তত্ববধায়ক ডা. মমিনুর হক জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজন নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। তারা হাসপাতালে ৭ জনের মরদেহ ও আহত ১২ জনকে নিয়ে আসেন। এরমধ্যে ১১ জনকে জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একজনকে আশংকাজনক অবস্থায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপালে পাঠানো হয়েছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালানা উদ্দীন বলেন, ‘ তেররশিয়া গ্রামের হোসেন আলীর মেয়ে সেমিআরা খাতুনের সঙ্গে সুর্যনারায়ণপুরের শরিফুল ইসলাম পাচু’র ছেলে মামুনের বিয়ে হয় ১ আগস্ট তারিখে। বিয়ের পর নতুন জামাই ও মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন হোসেন আলী। বুধবার আবার তাদের ফিরে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতায় সেমিআরার আর যাওয়া হলোনা’।
নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান মমিনুল হক বলেন, ‘ মর্মান্তিক এই ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো এলাকা। একসঙ্গে এতো লাশ। সুর্যনারায়ণপুরজুড়ে চলছে শোকের মাতম’। তিনি বলেন, ‘মাত্র চার দিন আগে মামুনের বিয়ে হয়েছে। নতুন বউ ও ছেলেকে আনতে আনন্দ উচ্ছাস নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন শরিফুল ইসলাম পাচু। কিন্তু বাড়ি ফিরলেন আপন ভাই, শশুড়, স্যালক, জামাইসহ অনেকের সঙ্গে লাশ হয়ে। ঘটনাটি বড়ই মর্মান্তিক’।
এদিকে, দুর্ঘটনার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে এঘটনায় আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, ‘ বজ্রপাতে আহত ১২ জনের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় জেলা প্রশসানের পক্ষ থেকে বহন করা হবে। নিহতদের পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে’। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিক আল রাব্বী জানান, শিবগঞ্জের পাকা ইউনিয়নের দক্ষিণপাকা তেররশিয়া গ্রামের মাঝি রফিকুল ইসলামের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইফফাত জাহান জানান, প্রাথমিকভাবে নারায়ণপুরের নিহত দু’জনের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। বাকিদের অর্থসহায়তা প্রদান করা হবে।
দুর্ঘটনার পর সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দীন আহম্মেদ শিমুল, শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং নিহত ও আহতদের পরিবারের খোঁজ খবর নেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ০৪ আগস্ট, ২০২১