চলে গেলেন ছাত্রলীগের গল্প বলার মানুষটি----- শহীদুল হুদা অলক

সানাউল হক পিন্টু। তাঁর বিশালতার একেবারেই ক্ষুদ্রাংশে আমার বিচরণ। ফলে যারা লেখাটি পড়বেন তারা অতৃপ্তই থাকবেন। রাজনীতির অঙ্গন এমনকি এর বাইরে শিা, জ্ঞান এবং একজন সজ্জন ও বিনয়ী মানুষ হিসেবেও তাঁর বিশালতার ছাপ সর্বজনবিদিত। আর সততা, সমাজে যেটির বড়ই অভাব। সেই সততার বিচারেও তিনি ছিলেন দৃষ্টান্ত।
বলছিলাম, ‘তাঁর বিশালতার একেবারেই ক্ষুদ্রাংশে আমার বিচরণ’ তবে এতো বিশেষণ আসে কিভাবে। হ্যাঁ, ক্ষুদ্রাংশে বিচরণ করেই বিশালতাকে অনুভব এবং পর্যবেণ থেকেই বলছি তিনি ছিলেন বিশাল, তিনি ছিলেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সানাউল হক পিন্টু দেশের সর্ববৃহৎ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম সেরাজুল হক শনি মিয়ার ছেলে ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সামিরুল হক মিন্টু’র বড় ভাই সানাউল হক পিন্টু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির মর্মান্তিক বিয়োগান্তের পর ওই এক কঠিন সময়ে তিনি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন। দুর্দিন হিসেবে বিবেচিত ওই সময়ে (১৯৭৯-১৯৮১) তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
তাঁর নেতৃত্ব পরখ করার সুযোগ হয়নি আমার বয়সের কারণে। তখন আমি একেবারেই শিশু। মনে আছে, আমার স্বর্গীয় পিতা অধ্যাপক জিকেএম শামসুল হুদার বাই-সাইকেলে চড়ে বহুদিন আওয়ামী লীগ অফিস এসেছি। কিন্তু তা ছিল, নিছক পিতার সঙ্গি হয়ে আসা-যাওয়া আর আমার অলস সময় কাটানো। দলীয় অফিসে বহু মানুষ দেখতাম কিন্তু কাউকে চিনতামনা। কারণ চেনার বয়সও ছিলনা এবং সে বিষয়টিতে ঝোঁকও ছিলনা। ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের নাম শুনেছি, শেখ গোলাম হাফিজ, বজলার রহমান ছানা, সানাউল হক পিন্টু, সাইদুর রহমান বেনু, খাবির উদ্দীন, সালামত আলী, নজরুল ইসলাম, এমরান ফারুক মাসুম প্রমুখের। আরো পরে আব্দুল হাই, মিজানুর রহমান প্রমুখ।
একজন কর্মী হিসেবে যখন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হলাম তখন জানার ব্যাপক আগ্রহ থেকে অগ্রজদের কাছে শুনেছি দুর্দিনে পিন্টু ভাই ও বেনু ভাইয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়ার কথা। শিশুকালে তাদের দেখেছিলাম কিনা মনে পড়েনা। তবে ছাত্রলীগে যুক্ত হয়ে শুধুই তাদের প্রসংশা শুনেছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের ( ১৯৯৫ সালের ২৭ মে) পর আমনুরার বেনু ভাই, তিনি আমেরিকা প্রবাসী হওয়ায় তার দেখা না পেলেও পিন্টু ভাইয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হতো মাঝে মধ্যেই। অসম্ভব বিনয়ী মানুষ। মুখে হাসির রেখা নিয়ে চলাফেরা করতেন। আর কথা বলতেন খুব নরম স্বরে।
প্রয়োজনীয় তথ্য কিংবা ব্যাখ্যার প্রয়োজনে ‘যথাযথ’ যায়গায় যাওয়া মানুষের সহজজাত নিয়ম। সকল নেতাদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, আমাদের সময় (অপু-অলক) সেই ‘যথাযথ’ যায়গাটি ছিলেন সানাউল হক পিন্টু। ওই সময় দেখেছি, কোন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিলে এবং আমরা আওয়ামী লীগ নেতার স্মরণাপন্ন হলে তাঁরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে বলতেন, ‘তোমরা পিন্টু’র সঙ্গে যোগাযোগ করো’। প্রচুর লেখা পড়া করতেন পিন্টু ভাই। অবসর সময় কাটতো লেখাপড়া করে। সেই কারণে জ্ঞানের পরিধিও ছিল ব্যাপক। তিনি ভাল লিখতেনও। নিয়মিত লিখতেন এমন তথ্য আমার জানা নেই। তবে, মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সাময়িকীতে তার লেখা ছাপা হয়েছে। পড়েছি, দারুণ রচনাশৈলী। দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন-এর ব্যবহার থাকতো যথাযথ। লেখাগুলো হতো একেবারে পরিপাটি। মনদিয়ে পড়া যেতো।
শুনেছি, পিন্টু ভাই একসময় দারুণ ক্রিকেট খেলতেন। এলাকার ঘনিষ্ট বন্ধু শফিকুল আলম ভোতাসহ অন্যদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সবুজ সংঘ’। সুসংগঠক পিন্টু ভাইয়ের গড়ে তোলা সবুজ সংঘ ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট লীগে দারুণ ‘ফর্মে’ ছিল। আমাদের সময়ে দেখা চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেডিয়ামে ক্রিকেটে ফাইনারে সবুজ সংঘের মুখোমুখি হতো মিতালী সংঘ। পরে যুক্ত হয় এনসিসি। আর ফুটবলের ক্ষেত্রে নবারুণ সংঘের প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল ন্যাশনাল কাব।
অগ্রজদের কাছ থেকে যেমনটা শুনেছি, ‘বঙ্গবন্ধু’তে তাঁর দখল ছিল ব্যাপক। লেখাপড়ার আর চর্চার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে তিনি অনেক বেশি জানতেন। দলীয় নেতাকর্মীদের জানাতেন, বলতেন। ৭৫ পরবর্তীতে তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, দনেতৃত্বের মাধ্যমে ছাত্রলীগ ‘প্রাণ’ ফিরে পেয়েছিল। তাঁর দতা দেখে সমসাময়িক সংগঠকদের বিশ্লেষণটা এই রকম, ‘সুসংগঠক পিন্টু ভাই যদি কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতেন, তবে অনেক বড়মাপের নেতা হতে পারতেন’। তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি আর একজন বিনয়ী মানুষ হিসেবে নিজ সংগঠনের বাইরের মানুষদের কাছেও তিনি ছিলেন প্রিয়মুখ। অনেকেই বলেন, সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে আত্মিক চলাচল আর সেই থেকে ‘সেতুবন্ধন’ রচনা করার কাজটি তিনি করে গেছেন সুনিপুনভাবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে কাজ করেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক গণমাধ্যমকর্মী বলছিলেন, ‘তাঁর রাজনীতিকে পচ্ছন্দ করেননা, কিন্তু তাঁকে পছন্দ করেন এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। আমরা তাঁর (পিন্টু ভাইয়ের) রাজনীতির ধারের কাছে ছিলামনা। তবে, তাঁকে খুব পছন্দ করতাম। আমাদের প্রিয়মুখ ছিলেন তিনি’।
মেধাবী ছাত্র পিন্টু ভাই, লেখাপড়া শেষে রাজনীতির সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদেন। মনে করা হয়, ‘তিনি কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে ভাল করতেন’। কিন্তু আমার মনে হয়, পিন্টু ভাই ঠিক ধারায় হেঁটেছিলেন। পিন্টু ভাইকে যতটুকু জেনেছি, তাতে বর্তমানে রাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি আর অপসংস্কৃতির ধারা চলছে তাতে বোধ হয় পিন্টু ভাই এধারায় বড়ই বেমানান। সৎ, পরিচ্ছন্ন মানুষদের যায়গা যে রাজনীতিতে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে’।
বলছিলাম সততার দৃষ্টান্তের কথা। পিন্টু ভাই বেশ কিছুদিন ধরেই বেশ কয়েকটি রোগে ভুগছিলেন। অসুস্থ্য পিন্টু ভাইয়ের খবর শুনতান অগ্রজ হাবিবুর ভাইয়ের (অধ্য হাবিবুর রহমান) কাছ থেকে। আমি নিশ্চিত নই, তবে মনে হয় পিন্টু ভাইযের সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ‘স্বাচ্ছন্দময়’ ছিলনা তাঁর কাছে। অথচ তিনি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসিতে) চাকরি করতেন। সেখানে চাকরি জীবনের শেষদিকে তিনি হয়েছিলেন, পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান। তাঁর হাত দিয়ে কোটি কোটি টাকার পরিকল্পনা, প্রকল্প হতো। অসৎ হলে নিজেও হতে পারতেন কোটি টাকার মালিক।
পিন্টু ভাইকে যেটুকু দেখেছি তাতে তাঁর মাঝে ক্রোধ দেখিনি। আমরা কোন প্রশ্ন বা আবদার নিয়ে গেলে অনেকটাই লাজুক প্রকৃতির পিন্টু ভাই বলতেন, ‘কি দরকার বাদ দাও ওসব’। আমরা না ছাড়লে তিনি মুখে হাসির রেখা রেখে বলতেন, ‘আচ্ছা শোনো......’। শুনেছি, তিনি প্রতিহিংসা পরায়ণ ছিলেননা। আমার ুদ্রাংশের দেখায় পিন্টু ভাইকে 'স্যুটেড- বুটেড' বাবু হিসেবে কখনও দেখিনি। তাঁর অফিসে দেখেছি একবার আর 'পথে- ঘাটে' তো বহুবার। সাধারণের মত 'সাদামাটা' পোশাকেই চলাফেরা করতেন।
প্রিয় পিন্টু ভাইয়ের সামান্য সান্নিধ্য পাওয়ার সুবাদে বেশ কিছু কথা, বেশ কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে। আগেই বলেছি, তাঁর কাছে গেলেই মুখে হাসি রেখেই কথা বলা শুরু করতেন। তাঁর মুখ থেকে শোনা, ছাত্রলীগের এক প্রশ্নকে ঘিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুজিবনগর সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদের সঙ্গে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ছাত্রলীগ নেতার বিব্রতকর প্রশ্নের জবাবে সেদিন তাজউদ্দীন আহম্মেদ বলেছিলেন, ‘ আমি যে পথ দিয়ে আসলাম সে পথে বড় গাব গাছ দেখলাম (হরিমোহন স্কুল সংলগ্ন গাবতলা)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জন্য খ্যাত কিন্তু গাব গাছে কখনও আম ধরবেনা’। জানিনা, তাজউদ্দীনের সেই কথাটি তিনি কিভাবে নিয়েছিলেন, আমাদের শুনিয়েছিলেন দারুণভাবে। তার চমৎকার উপস্থাপন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতান। আর সাংগঠনিক কোন আয়োজনে তিনি যখন বক্তব্য রাখতেন, তখন তিনি ইতিহাসের পাতায় পাতায় ঘুরে তুলে ধরতেন বাঙ্গালির ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস। সেই সুবক্তা, ছাত্রলীগের গল্প বলার মানুষটি চলে গেলেন...