বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ও তাঁর শহীদিস্থল খুজে ফেরা...

শহীদুল হুদা অলক >  গেল ১৪ ডিসেম্বর ছিল বাংলা মায়ের দামাল সন্তান ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের ৪৬ তম শাহাদাত বার্ষিকী। মহান মুক্তিযুদ্ধে ওই দিন সাহসি সন্তান জাহাঙ্গীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের মহানন্দা তীরের রেহায়চরে সম্মুখ যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর ছোড়া গুলি কপালে বিদ্ধ হয়ে সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন। মুক্ত বাংলাদেশের মাত্র দু’দিন আগে তাঁর প্রাণ কেড়ে নেয় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোশররা। দেশের জন্য আত্মত্যাগ, সাহসিকতা ও বীরত্বের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করে।
তখন আমার স্কুল গন্ডির শেষ সীমানায় অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একটা আলাদা অনুভূতি ছিল আগে থেকেই। ওই স্কুল জীবনেই গ্রামের ক’জন বন্ধু মিলে একটা ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। প্রতিযোগিতা আয়োজনের নেতৃত্বের আসনে থেকে ওই ‘আলাদা অনুভূতি’র যায়গা থেকে প্রতিযোগিতার নামকরণ করি ‘শক্যামজা’ গোল্ডকাপ ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েই প্রতিযোগিতার নামকরণ করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের নামে প্রতিযোগিতার আয়োজনের কারণে তাঁকে জানার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এখনতো ইন্টারনেটের যুগ ‘গুগল মামা’ ব্যবহারে অনেক কিছুই পাওয়া যায় এবং সেই সুত্রধরে অনেক কিছুই জানা যায়। কিন্তু তখন তাঁকে জানার সুযোগ ছিল পাঠ্যপুস্তক, প্রকাশনা, সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাধারণ পাঠাগারে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ে খুঁজে ফিরতাম বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরকে। জেনেছিলাম, বরিশালের মেধাবী সন্তান, মৌলভী আব্দুল মোতালিব হাওলাদারের ছেলে মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের শিশুকাল থেকে বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক কিছুই। এখন গুগলে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর লিখে সার্চ দিলে তাঁর কতই না ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু মনে আছে, ওই সময় জাহাঙ্গীরের ছবিটা আমরা সংগ্রহ করেছিলাম স্বশস্ত্র বাহিনী দিবসে সংবাদপত্রের ক্রোড়পত্রের উপরের অংশে থাকা সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবিগুলোর মধ্য থেকে।
ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার প্রথমবারের সফল আয়োজনের পর একাএকাই কতবার যে রেহায়চর গেছি এখন সংখ্যায় মনে নেই। খুজে দেখার চেষ্টা ছিল, রেহায়চরের কোথায় ওই (১৪ ডিসেম্বর) যুদ্ধ হয়েছিল। অগ্রজদের কাছ থেকে শুনে অনুভব করার চেষ্টা করেছি ওই দুঃসাহসিক যুদ্ধদৃশ্য। অগ্রজরা বলেছিলেন, ‘ এই যায়গা (এলাকা দেখিয়ে দিয়ে) থেকে এই যায়গা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়েছিল। আর উত্তর-পূর্ব কোণের মসজিদের পাশ থেকে ছুটে আসা গুলিতে তিনি শহীদ হন’। ওই দিন (১৪ ডিসেম্বর) রাতের আধার কেটে ভোরের সূর্য ওঠার আগেই নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জাহাঙ্গীর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলেন এবং ধ্বংস করে দেন শত্রু বাহিনী ১৮টি ট্রেঞ্চ ও ২০ থেকে ২২ টি বাংকার। জাহাঙ্গীরের দুঃসাহসিক ও দুরন্ত আক্রমণে শত্রু বাহিনী তাদের আস্তানা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। শত্রু বাহিনীর সর্বশেষ বাংকারটি দখল করতে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এগুতে থাকার সময় হটাৎ শত্রু বাহিনীর একটি গুলি এসে লাগে তাঁর কপালে। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে বাংলার এই বীরসন্তান। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি টাইগার নামে পরিচিত। শত্রুবাহিনীর গুলিতে শহীদ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে ‘আমাদের টাইগার আর নেই’।
কিন্তু তিনি কোন স্থানে শহীদ হযেছিলেন। মহানন্দা নদী তীরেই বট কিংবা পাইকুড় গাছ তলায় বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর স্মৃতি সংঘ ছিল। ওই সংঘের ঘরটি যেটি সেখানেই কি তিনি শহীদ হয়েছিলেন? জানার আগ্রহ ছিল প্রবলভাবেই। সেই সঙ্গে উদ্দেশ্য ছিল শহীদিস্থলটি চিহ্নিত করা। স্থানীয় প্রবীণ মানুষের কাছ থেকে পৃথক পৃথকভাবে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মরহুম রোজিউর রহমান বিশু, সাবেক কমান্ডার মরহুম ওমর ফারুক, মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ এনামুল হক ফিটুসহ কয়েকজনকে আলাদা আলাদাভাবে স্বশরীরে রেহায়চরে নিয়ে গেছিলাম। তাঁরাও আমার উদ্যোগে পুর্ণাঙ্গভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। এরমধ্যে অধ্যক্ষ এনামুল হকের সহযোগিতা ছিল বেশী। যুদ্ধদিনের ঘটনা, লাশ পড়ে থাকার স্থান আর মসজিদের পাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসা গুলি’র রেখাপথ অনুমান করে জানিয়েছিলেন রেহায়চরস্থ মহানন্দার নদীর উপর সেতু নির্মাণকারী চীনা প্রতিষ্ঠানের অফিস ও জনবল থাকার জন্য যে অবকাঠামো ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয় (বর্তমানে সড়ক ও জনপথ বিভাগ অফিস) সেই সীমানা প্রাচীরের পশ্চিম দিকে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। যখন যায়গাটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করি তখন তা ছিল ঝোপঝাড়ে পুর্ণ। সওজ’র কর্মচারীরা বেগুন ও অন্যাান্য ফসল আবাদ করতো।
কিছুক্ষণ ফিরে আসি ব্যাডমিন্টন প্রসঙ্গে। এরই মাঝে ‘শক্যামজা’ গোল্ডকাপ ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার দু’টি আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তৃতীয়বারের বেলায় চিন্তা করেছিলাম প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী দিনে কিংবা সমাপনি দিনে বীরশ্রেষ্ঠের পিতাকে নিয়ে আসবো প্রধান অতিথি হিসেবে। কিন্তু তা হয়নি। প্রতিযোগিতাটি প্রতিবছর শুরু হতো ১৪ ডিসেম্বরে। তখন কনকনে শীত। তিনি বয়স্ক মানুষ ওই শীতে তাঁর কষ্ট হবে সেই কারণে তা করা যায়নি। কিন্তু তাঁকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিয়ে আসবোই। অধ্যক্ষ এনামুল হকের সহযোগিতায় তাঁকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম। প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। সুদর্শন একজন মানুষ। বয়সের ছাপ পুরো শরীরজুড়ে। মুখে শুভ্র দাড়ি। মায়াবি দু’টি চোখ। সন্তানের কথা মনে করিয়ে দিতেই সাদা মানুষটি মুখ মলিন হয়ে গেল। সে এক ভিন্ন অনুভূতি।
ওই যে বলছিলাম, ‘তাঁকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিয়ে আসবই’ মনের মধ্যে সংকল্পের কথা। তখন আমি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র সংগঠনের নেতা রক্তে একটু তেজ বেশী ছিল। স্থীর করে ফেললাম বীরশ্রেষ্ঠের শহীদিস্থলে ভিক্তিপ্রস্তর স্থাপন করবো। তা করবো, শহীদ পিতা মোতালেব হওলাদারকে দিয়ে। তিনি সাড়া দিলেন। পাশে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক ফিটু মামা। উদ্যম আরো বেড়ে গেল। ইট, বালু, সিমেন্ট আর নাম ফলক সংগ্রহ করে বেগুনের ভুই আর ঝোপঝাড়ের ভেতর যেখানে জাহাঙ্গীরের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল শত্রুবাহিনী সেখানে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে ফেললাম। দিনটি ছিল ১৯৯৯ সালের ২ জুন।
হালে (ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ১২ বছর পর) আমাদের স্থাপন করা ভিত্তিপ্রস্তরকে পেছনে ফেলে আধুনিক রূপে নির্মাণ হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর স্মৃতিস্তম্ভ। এই ফলকে অনেকের নাম। তবুও গর্বলাগে সাহসী সন্তানের স্মৃতিস্তম্ভ দেখে। সালাম বাংলার টাইগার, সালাম জাহাঙ্গীর তোমাকে, তোমার বীরত্বকে...


চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ শহীদুল হুদা অলক/১৪-১২-১৭