চরলক্ষিপুর > পদ্মার বুকে সাজানো গ্রামের বিবর্ণ জীবনগাঁথা

সর্বগ্রাসী পদ্মার ভাঙ্গনের সঙ্গে যুদ্ধ কোইর‌্যাই বাঁচ্যা আছি। হাঁর সংসার জীবনে এখন যেখ্যানে বাড়ি বাইন্ধ্যাছি সেট্যা তিন নম্বর বাড়ি। এ্যার আগেও দুবার বাড়ি ভ্যাঙ্গাচ্ছি। বাড়ি ভাঙ্গছি আর গড়ছি আর পদ্মাও ভাঙ্গছে। একাদবারে বাড়ি বান্ধা (তৈরী করা) মানে ম্যালাই টাকা। কম কোইর‌্যা হোইলেও ষাট সহত্তর হাজার কর‌্যা খরচ কর‌্যাছি। অভার আর কষ্টের সংসার। কোন রকমে বাঁচ্যা আছি। জারে (শীতে) কাহিল অবস্থা। এত্তো জার আগে দেখিনি। কনকোন্যা বাতাস ছাইল্যা পিল্যা লিয়্যা খুব কষ্টে আছি। গরম কাপড় নাই। খড়কুটা জাইল্যা আগুন পোহি। কিন্তু কতোক্ষণ। কথা গুলো বললেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নাধীন চরলক্ষিপুর  নতুন হঠাৎপাড়া  গ্রামের দবিরের স্ত্রী মোসা: রোজিনা বেগম।
রোববার পদ্মাতীরের চরলক্ষিপুরে গিয়ে কথা হয় রোজিনা বেগমের সাথে। শুধু সে নয় তার  মত ৪০/৫০জন নারী পুরুষের সাথে কথা হয়। তারা জানান, গত কয়েক বছর আগে পদ্মা নদীর মাঝখানে চরলক্ষিপুর নামে একটি গ্রাম ছিল। যে গ্রামটির চারিদিকই পদ্মা নদী। কৃষিকাজ করে চরে বসতি গড়া মানুষগুলো মোটামুটি সংসার চালাতো। কিন্তু মোটামুটি সংসার জীবন চালিয়ে নেয়া মানুষগুলোর বসতিতে আঘাত হানে পদ্মা। গেল বছর ওই গ্রামটি তিনবার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। দুইবার গ্রামের এক স্থান হতে অন্যস্থানে বাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে। যেন চরের ভেতরই যাযাবর জীবন। গ্রামবাসী জানান, তৃৃতীয়বারের ভাঙ্গনে আর কোন যায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে মূল গ্রাম থেকে নতুনভাবে জেগে উঠা চরে এসে বসতি করেন তারা। ছন্নছাড়া হয়ে শতাধিক পরিবার নতুন করে বসতি গড়েছে চরলক্ষিপুরের হটাৎপাড়া গ্রামে। কিন্তু এখানে চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলে শিক্ষার মান একে বারে নীচে গেছে। নদী ভাঙ্গনের কারণে সর্বশান্ত হওয়া গ্রামের মানুষের মূল পেশা কৃষি হলেও নিজস্ব জমি না থাকায় বেশির ভাগই কামলা খাটেন পড়ের জমিতে।

হটাৎপাড়ার ছবিয়ারা বেগম বলেন, ‘আমাদের এ গ্রামে কোন অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। রোগী নিয়ে এখান থেকে ৮ কিলোমিটার নদী পথের রাস্তা অতিক্রম  করে যেতে হয়। বিশেষ করে ডেলীভেরী রোগীর ক্ষেত্রে মহিলাদের অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। এমনকি উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কোন সময় মা, কোন সময় গর্ভের সন্তানকে হারাতে হয়।
গ্রামের রায়হান মাসুদ, বশীরসহ আরো কয়েকজন যুবক জানান, আমরা কষ্টের মাঝে থাকলেও কেউ তেমন খোজ নেইনা। অনেক স্থানে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও এই গ্রামে এখনো তেমন কেউ আসেনি। সরকারী সাহায্য বলতে কয়েকজন বিধবা, বয়স্ব ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা পায়।
তারা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভাঙ্গনের কবলে পড়ায় নতুন করে হটাৎপাড়াতে নতুন স্কুল করা হচ্ছে কিন্তু শিক্ষকদের বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় প্রতিদিন আসতে পারে না। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা একে বারে ভেঙ্গে পড়েছে। সব মিলিয়ে এ গ্রামের  শতাধিক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

স্থানীয় এ্যাডভোকেট রাসেল রহমান বলেন, ‘সরজমিনে না দেখলে বিস্বাস হবে না যে অধিকার বঞ্চিত হয়ে এলাকার মানুষ কত কষ্টে আছে’। পাকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, ‘চরলক্ষীপুর গ্রাম মানুষ বহুদিন ধরেই অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে আছে। তবে গত বছর থেকে তাদের কষ্টের মাত্রা বহুগুনে বেড়েছে’।
এব্যাপারে পাকা ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে, শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ বরাদ্দ পাওয়া শীতবস্ত্র ইউনিয়ন অনুযায়ি বন্টন করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে কোন শীত বস্ত্র না থাকায় নতুন করে কোন বরাদ্দ দেয় সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে’।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ সফিকুল ইসলাম সফিক, নিজস্ব প্রতিবেদক, শিবগঞ্জ/ ২৯-০১-১৮

,