৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস> প্রবীণ নারী, অব্যক্ত বেদনাগুলো চার দেয়ালের ফ্রেমে বন্দি

 রহিমা বেওয়া। সত্তোরোর্ধ এর অসহায় নারী। অতীত প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা হলে আজকে তাঁর নামের সহিত অসহায় শব্দটি ব্যবহার দৃষ্টিকটুই বটে। পিতা ও স্বামীর তৎকালীন অবস্থা বিবেচনা করলে আজকের তাঁর এই অসহায়ত্বের সাথে কেহই মিলাতে পারবেন না। পিতা ছিলেন নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার স্বনামধন্য পরিবারের সন্তান। যাদের নাম ডাকে নাকি বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খেত। আইন শৃঙ্গলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর কথায় উঠবস করত। অন্যদিকে স্বামী ছিলেন পাশ^বর্তী মহাদেবপুর উপজেলার আর এক ধর্নাঢ়্য পরিবারের সন্তান। সে সময় পড়ালেখার প্রতি মানুষের গুরুত্ব না থাকায় রহিমা বেওয়ারও বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। তবে স্বামী কিছুটা হলেও লিখাপড়া জানতেন।

নিজেরা শুধু  তিন বোন হলেও রহিমা বেওয়ার ছিল একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। এক সময় সংসার সম্পদে টইটুম্বর থাকলেও স্বামীর অসহযোগিতা ও অত্যাচারের কারণে সেগুলো ধরে রাখতে পারেননি। মেয়েকে সুরক্ষার জন্য পিতা রহিমা বেওয়াকে স্ব-পরিবারে মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে নিজের কাছে পত্নীতলায় নিয়ে আসেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। স্বামীর উদাসীনতা ও সংসার বিমুখতার কারণে সব সম্পদ আস্তে আস্তে শেষ হতে থাকে। শেষ সম্বল স্বামীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রহিমা বেওয়া বাড়ি-ভিটাসহ অন্যান্য সম্পদ ছেলে-মেয়েদের নামে লিখে দেন। স্বামীকে ত্যাগ না করলেও তাঁর সহিত আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকেন। আমার জানা মতে ক্ষোভে ও রাগে ৩০ বছরেরও অধিক সময় তিনি স্বামীর সহিত কথা বলেননি। এক হাড়িতে পাক, খাবার গ্রহণ ও শয্যাসঙ্গী হননি। বছর তিনেক আগে রহিমা বেওয়ার স্বামী মারা গেছেন। স্বামীর মৃত্যু তাকে ব্যথিত না করলেও একমাত্র ছেলের আচরণ তাঁকে চরমভাবে ব্যথিত করে। সব কিছুই স্বাভাবিক গতিতে চললেও মায়ের জন্য জোটেনা এক থালা ভাত। বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ থাকলেও রহিমা বেওয়ার ঘরে অন্ধকার। যে বাড়িটি তিনি ছেলের নামে লিখে দিয়েছেন সেই বাড়ি হতেই এখন তাকে কথায় কথায় বের করে দিতে চায় ছেলে ও ছেলের বউ। এই চরম কষ্টের কথা রহিমা বেওয়া কাহাকেও বলতে পারেন না। শুধু ধুঁকে ধুঁকে কাঁদেন। এত কিছুর পরও তিনি একমাত্র ছেলের অমঙ্গল চাননা। বরং ছেলেক কেউ কিছু  বললে তাঁর পক্ষে অন্যের সাথে ঝগড়া করেন। কারণ তিনি হলেন মা। রহিমা বেওয়া সরকারের কাছ থেকে বিধবা ভাতা পান। সেটিসহ নিকট আতœীয়দের  কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে অন্ধকার ঘরে নিঃসঙ্গ ভাবে জীবণ যাপন করছেন আর মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

রহিমা বেওয়ার বর্তমান যে অবস্থা বর্ণণা করা হলো তা বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ নারীর প্রতিচ্ছবি। মানুষ প্রবীণ হলে পরিবার ও সমাজে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। পরিবার ও সমাজের কাছে তাঁরা বোঝায় পরিণত হন। পুরুষ প্রবীণরা বাহিরে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সহিত কথা বলে নিজেদের কিছুটা হলেও হালকা করে নিতে পারেন। কিন্তু প্রবীণ নারীদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ অনেকটাই সীমিত। তাদের দুঃখ-কষ্টগুলো বাড়ির চার দেয়ালের মাঝে ঘুরপাক খায়। আমৃত্যু সেখানেই গড়ে ওঠে তাদের কল্পনার জগত। পরিবারে কোন প্রবীণ নারী থাকলে পাহারাদারের দায়িত্ব গিয়ে তাঁর উপর বর্তায়। পরিবারের শিশুদের লালন-পালন করা, দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করে প্রবীণ নারী।  সদস্যরা বাড়ির বাহিরে বা আতœীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে বাড়ি-ঘর পাহারা দিতে হয় প্রবীণ নারীকে। পরিবারের সদস্যরা ভুলেই যায়, বর্তমানে তাঁরা যে কাজে সময় ব্যয় করছেন সেই কাজগুলো পাড়ি দিয়েই প্রবীণরা আজ এখানে এসে উপনীত হয়েছে। তাই সঙ্গত কারণেই প্রবীণদেরও স্বাদ জাগে একটু বাহিরে যাবার, ভালো-মন্দ কিছু খাবার গ্রহণ করা বা পরিবারের সদস্যদের সহিত আনন্দগুলোকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার। 

বর্তমান যান্ত্রিক উৎকর্ষের দিনে মানুষের কাজের পরিধি বেড়ে গেছে। আগের দিনে গ্রামের নারীরা বিশেষতঃ বয়স্ক নারীরা দুপুরের খাবারের পর গ্রামের কোন স্থানে মিলিত হয়ে গল্পগুজব করতেন। কেউ অন্য জনের মাথার উঁকুন তুলে দিতেন, কেউবা খেজুর পাটি বুনাতেন আবার কেউ সুঁই-সুতা দিয়ে বিভিন্ন রকমের ফুল তুলতেন বা উলের সোয়েটার তৈরী করতেন প্রিয়জনদের জন্য। কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগায় এই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। একান্নবর্তী পরিবারের পরিবর্তে একক পরিবারের বিকাশ লাভ করায় মানুষ নিজেকে নিয়ে বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই প্রবীণ নারীরাও তাদের মনের কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে পায়না। স্বামী বেঁচে থাকা পর্যন্ত একজন নারীর কিছুটা অবলম্বন থাকলেও বিধবা হওয়ার পর তাঁরা চরম নিঃসঙ্গতার দিকে এগিয়ে যায়।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপনের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সেখানে নারীর উন্নয়ন, নারীর সাফল্য গাঁথা, সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হবে। সেই সাথে পরিবার ও সমাজে প্রবীণ নারীর দুঃখ-কস্ট ও বেদনার দিকটি নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ও হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ এর কারিগরী সহায়তায় নওগাঁ জেলায় প্রবীণ অধিক্ষার সুরক্ষায় কর্মরত বেসরকারি সংগঠন বরেন্দ্রভূমি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (বিএসডিও’র) নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রউফ জানান, শুধু প্রবীণ নারীই নয়, এই জনগোষ্ঠির সমস্যাগুলো নিয়ে বিএসডিও জেলার ৪টি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ‘প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায়  সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযান প্রকল্প’ পরিচালনা করছে। এজন্য নওগাঁ জেলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক আঙ্গিক ব্যবহার করা হচ্ছে। তৃণমূলের ৪৮টি সাংস্কৃতিক দলের সদস্য ও গণমাধ্যম কর্মীরা এই কর্মকান্ডের সহিত জড়িত আছে। কমিউনিটির জনগণ ও সেবা দাতাদের সংবেদনশীলকরণের মাধ্যমে প্রবীণ অধিকার সুরক্ষাই এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে তিনি জানান।




চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/  আতাউর রহমান, নিজস্ব প্রতিবেদক, পত্নীতলা, নওগাঁ/ 08-03-16