মাদকবাহী ট্রাকের চাকায় জীবন প্রদীপ নিভে গেল দু’ পুলিশের (বিস্তারিত)

কানসাটের লোকালয় তখনো পুরোপুরি জেগে উঠেনি। আকাশটা কেবল ‘পরিস্কার’ হয়েছে। সোনামসজিদ মহাসড়কের পথ ধরে স্থল বন্দরে যাওয়া আসা ট্রাক চলাচল করছে স্বাভাবিকভাবে। এইসব ট্রাকের মধ্যেই নির্দিষ্ট ট্রাকে ফেন্সিডিল পাচার হচ্ছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযানে গিয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক সাদেকুল ইসলাম ও সার্জেন্ট আতাউল ইসলাম। মাদকবাহী ট্রাককে থামার সংকেত দেয়ার পর সাহসিকতার সঙ্গে গতিরোধ করতে ওই  ট্রাকের চাকায় জীবন প্রদীপ নিভে গেল তাদের। বৃহস্পতিবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে শিবগঞ্জের কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামনে ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, সোনামসজিদ স্থল বন্দর ও পার্শ্ববর্তী সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে দেদারসে ঢুকছে ফেন্সিডিল। আর এসব ফেন্সিডিল কখনো ট্রাকযোগে পণ্যের আড়ালে, কখনোবা গোপন কুঠরি তৈরী করে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল ভারত থেকে ঢুকছে ওই পথ দিয়ে। বন্দর এলাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রাকযোগে মাদকের চালান যাচ্ছে ঢাকায় এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাদেকুল ইসলাম ও আতাউল ইসলাম আগে থেকেই কানসাট গোপালনগর মোড়ে অবস্থান নেয়। পোগালনগর মোড়ে ট্রাকটিকে থামার সংকেত দিলে ট্রাক চালক সংকেত অমান্য করে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করে। মটরসাইকেল নিয়ে অভিযানে যাওয়া সাদেকুল ও আতাউল তড়িৎ ধাওয়া করে ট্রাকটিকে। মাত্র এক কিলোমিটারের সামান্য বেশী দূরে এসে ট্রাকের সামনে দিক থেকে গতিরোধের চেষ্টা করেন তারা। এই সময়েই ট্রাক চালক ধাক্কা দেয় সাদেকুল ও আতাউলকে। তাদের বহন করা মটর সাইকেলটি ছিটকে পড়লে ট্রাকের চাকা যায় সাদেকুল ও আতাউলের পায়ের উপর দিয়ে। ঘটনাস্থলেই মারা যান তারা।
 



শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এমএম ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ গাড়ির গতিরোধ করছে দেখে ট্রাক চালক পেছন থেকে তাদের চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসি। পরে তা ময়না তদন্তের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়’।
এদিকে, মাদবাহী ট্রাকের চাপায় সাদেকুল ও আতাউলের মৃত্যু সংবাদ থানায় এসে পৌছলে থানায় শোকের ছায়া নেমে আসে। খবর পেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আল মামুন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
শিবগঞ্জ থানায় কর্মরত সাদেকুল ও আতাউলের সহকর্মীরা জানান, শিবগঞ্জ থানার উপ পরিদর্শক সাদেকুল ইসলাম প্রায় এক বছর আগে থানায় যোগদেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার রাজারামপুর গ্রামে আব্দুস সাত্তারের একমাত্র ছেলে সাদেকুল ইসলাম দু’ কন্যা সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে শিবগঞ্জের একটি বাসাবাড়িতে বসবাস করতেন। ওই বাসাবাড়িতে মৃত্যু খবর পৌছলে থানায় ছুটে আসেন সাদেকুলের স্ত্রী। থানাজুড়ে তখন শুরু হয় শোকের মাতম।
 তারা জানায়, ট্রাকের চাকায় প্রাণ হারানো জয়পুরহাটের ধীরতি সুতিঘাট এলাকার শাহজাহান আলীর ছেলে আতিকুল ইসলাম শিক্ষানবিশ পুলিশ সার্জেন্ট মাত্র ১৫ দিন আগে শিবগঞ্জ থানায় যোগ দিয়েছিলেন। তিনি শিবগঞ্জ ডাকবাংলোর একটি ঘরে বসবাস করতেন। চাকরীর শিক্ষা জীবনের শুরুতেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল।
সাদেকুল ও আতাউলের সহকর্মীরা বলেন, ‘ খুব হাসিখুশি ও বিনয়ী ছিল তারা’।
ট্রাক ও ট্রাক চালক আটক

কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামনে দু’ পুলিশকে পিশে মারার পর চালক ট্রাক নিয়ে পালিয়ে গেলে পুলিশ তাৎতক্ষণিক চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সবধরণের বহিঃগমন পথে অস্থায়ী পুলিশ চৌকী বসায়। অবশেষে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভোলাহাট সড়কের কাশিয়াবাড়ি এলাকায় ধরা পড়ে ট্রাক চালক সেরাজুল ইসলাম (৩৮)। আটক সেরাজুল ইসলাম ঝালকাঠি জেলার নলছিটির অনুরাগ গ্রামের আওয়াল হোসেনের ছেলে। শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এমএম ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘ পুলিশ সদস্যদের হত্যার পর ট্রাক চালক ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়ে মনাকষা সড়কে। সেখান থেকে শ্যামপুর দিয়ে ঢোবপুকুর-ভোলাহাট সড়কের কাশিয়াবাড়ি স্কুলের সামনে ধরা পরে পুলিশের হাতে’। তিনি বলেন, ‘ গোপন সংবাদের তথ্য সঠিক ছিল সিরাজুলের ট্রাকের উপর থেকে বস্তাবন্দ্বি ১ হাজার ৪৫০ বোতাল ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়’।
ময়না তদন্ত শেষে নামাজে জানাজা
ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধারের পর শিবগঞ্জ থানা পুলিশ তা ময়না তদন্তের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাকের চাকায় পিষ্ট সার্জেন্ট আতাউল ইসলামের পেটের নিচ থেকে দেহের বাকি অংশ ও এসআই সাদেকুল ইসলামের ডান পা বিছিন্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া দুজনের পেটের নিচের অংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থায় ছিল। তাঁদের দেহ ট্রাকের সামনের ও পিছনের চাকায় পিষ্ট হওয়ায় এ বিভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়’।
ময়না তদন্ত শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলকার নয়াগোলা এলাকায় অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ লাইনে। সেখানে নামজে জানাজা শেষে তাদের পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। বিকেলে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের গ্রামের বাড়িতে।
মামলা দায়ের সুযোগ পাবে নিহতের পরিবার
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার বশির আহমেদ পিপিএম বার বলেন, ‘এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড এঘটনাায় চাকলকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও মাদক চোরাচালানের জন্য বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে’। তিনি বলেন, ‘যেহেতু তারা অনডিউটি নিহত হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের পারিবারকে সব ধরণের সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে’।


চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ০৩-০৩-১৬