কোন্দলে নাজেহাল আওয়ামী লীগ > শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুরের শীর্ষ ৮ নেতা বহিস্কারের জালে

সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করার অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানীকে সাময়িক বহিস্কারের পর এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমানকে বহিস্কারের আবেদন করা হয়েছে। গোলাম রাব্বানীকে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হলেও রহনপুর পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করার অভিযোগে জিয়াউর রহমানসহ ৫ আওয়ামীলীগ নেতাকে বহিস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে গোমস্তাপুর উপজেলা ও রহনপুর পৌর আওয়ামী লীগ থেকে। চুড়ান্ত বহিস্কারের জন্য ওই সিদ্ধান্তের কপি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এনিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুর উপজেলার ৮ শীর্ষ নেতা বহিস্কারের জালে জড়ালেন। এদিকে বহিস্কারের ঘটনায় দীর্ঘদিন থেকে রহনপুর আওয়ামী লীগে বিরাজ থাকা আভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্ব আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট, গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলা নিয়ে গঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংসদীয় আসনের মধ্যে বাণিজ্যিক কারণে সমৃদ্ধ রহনপুরকে ‘রাজনৈতিক রাজধানী’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এখানে আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত বহু আগে থেকেই। রহনপুর পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তা ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। ওই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস রহনপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র পদ ছেড়ে গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে মোস্তফা পরাজিত হওয়ার পর আবারও পৌরসভার উপনির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৫ জানুয়ারি’র নির্বাচনে গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে আবারও উপ নির্বাচনের মুখে পড়ে রহনপুর পৌরসভা। এতে গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের ছোট ভাই গোলাম রাব্বানী বিশ্বাস মেয়র নির্বাচিত হন। টানা বিজয়ের ধারায় এবারই ছন্দপতন ঘটে। ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি’র প্রার্থী তারেক আহম্মেদের কাছে এক হাজার ৮৮৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন নৌকার প্রার্থী গোলাম রাব্বানী বিশ্বাস। ওই সূত্র জানায়, রহনপুর পৌরসভা নির্বাচনে গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের অনুসারী শুধু মেয়রই নয়, ৯ সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ৩ সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীরাও পরাজিত হন। ৯টি সাধারণ ওয়ার্ডের ৪/৫টিতে কাউন্সিলর বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী সমর্থক প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীকেই হারিয়ে। এনিয়ে দলের মধ্যে আভ্যন্তরিণ প্রকট আকার ধারণ করে।
নির্বাচনের পর গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের অনুসারীদের পরাজয়ের জন্য সাবেক এমপি জিয়াউর রহমান অনুসারীদের দায়ি করে নানামুখি তৎপরতা শুরু করেন। একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন। 
দলীয় সূত্র জানায়, রহনপুর আওয়ামী লীগে আভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্বের কারণে এক সময় একই এলাকায় দু’টি আওয়ামী লীগের অফিস ছিল। সাম্প্রতিক সময়ের জিয়া গ্রুপের সঙ্গে মোস্তফা গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে একে অপরকে ঘায়েল করতে খোদ আওয়ামী লীগের কর্মীরাই নানাভাবে হয়রানীর শিকার হয়েছেন এমনকি মামলারও আসামী হতে হয়েছে। ওই সূত্র জানায়, জিয়াউর রহমান এমপি থাকার সময় মোস্তফা গ্রুপ কোনঠাসা অবস্থানে থাকলেও এবার গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস এমপি হওয়ার পর ‘দাপুটে’ অবস্থানে আসে মোস্তফা গ্রুপ।
এদিকে দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে দলীয় কোন্দল প্রভাব রাখলেও গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের রাজনীতিকে পারিবারিক করণকেও ভাল চোখে দেখেনি কর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘ পৌরসভার মেয়র থেকে মোস্তফার বাদ পড়ার পর দলের অন্যকোন নেতাকে সুযোগ না দিয়েই তিনি তার আপন ভাইকে মেয়র করেছিলেন। একইভাবে উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনে পরিবারের লোকজনদের নেতা করেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাধানগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়রম্যান মামুনুর রশিদ মোস্তফার আপন মামতো ভাই আর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বিশ্বার আপন ছোট ভাই’। তিনি বলেন, ‘ এর বাইরে দলীয় কোন্দলের কারণে সমন্বয়হীনতা এবং যথাযথ তদারকি না করার কারণেও দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত হতে হয়েছে। জিয়াউর রহমান ‘জনসম্মুখে’ মানে উপরে উপরে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলেও তার অনুসারীরা তলে তলে ঠিকই ভিন্ন কাজ করেছেন। মোস্তফা অনুসারীরা এই কৌশল ধরতেই পারেনি। মহিলা কর্মীরাও ভিন্ন সুরে কথা বলেছেনে’।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও রহনপুর পৌর আওয়ামী লীগ সভা করে নির্বাচন মূল্যায়নকালে ওই সভার অনেক সদস্যই প্রাকাশ্যে দলীয় মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান ও তাদের অনুসারীদের কাজ করার নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। তারা অভিযোগ করেন, জিয়াউর রহমান নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কৌশলে নৌকার পক্ষে কাজ না করে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করিয়েছেন। ফোনে ফোনে নৌকার বিপক্ষে ভোট দিতে বলেছেন।
গত ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দু’ শাখার কার্যকরি কমিটি সভায় বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ভোট করার অভিযোগে সাবেক সংসদ সদস্য ও গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য জিয়াউর রহমানসহ ৫জনকে বহিস্কারের জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করা হয়। অন্য চার নেতা হচ্ছেন, আওয়ামীলীগ সদস্য মোহাম্মদ আলী সরকার, জেলা মহিলা আ’লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হালিমা বেগম, গোমস্তাপুর উপজেলা আ’লীগের কার্যকরী সদস্য জালাল উদ্দিন আকবর মুক্তি, রহনপুর পৌর আ’লীগের কার্যকরী সদস্য নজরুল ইসলাম ও আ’লীগ সদস্য আব্দুল হান্নান। কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানো ওই সিদ্ধান্তের কপিতে স্বাক্ষর করেছেন, গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাজাহান আনসারী, সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ, রহনপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আজিজ ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বিশ্বাস।
সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থীর পরাজয়ের পর দলীয় কোন্দল আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বর্তমানে উভয়গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।
এ ব্যাপারে গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে কতিপয় দলীয় নেতার কাজ করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো সভায় আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের অনুলিপি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠনো হয়েছে’। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান বলেন, ‘ অভিযোগগুলো সম্পুর্ণ  মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমুলক। হাজার হাজার লোকের সামনে নৌকাকে ভোট দিতে বলি, সেটা সবাই জানেন। দলের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়ায় কর্মীরা বিভক্ত হয়ে ভোট করায় মেয়র প্রার্থীর পরাজয় ঘটে’।
উল্লেখ্য, এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী কারিবুল হক রাজীনের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী, সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আতাউর রহমান ও শিবগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কারিবুল হক রাজিনকে সাময়িক বহিস্কার করে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ২৬-০১-১৬

, ,