বাহাদুর ও তার মেয়ের বোবাকান্না

তার নাম যে রুহুল আমীন তা জানা ছিলনা। প্রতিবন্ধি মানুষ আমরা তাকে বাহাদুর বলেই চিনতাম। সেই বাহাদুরকে (রুহুল আমীন) রোববার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের ক্লাব সুপার মার্কেটের সামনের একটি বিকাশের দোকানে দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘বোবাকান্না’ কাঁদছেন। দু’চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে কান্না’র জল। তারপাশে একটা টুলের উপর বসা একটি মেয়েও মুখ ঢেকে ওই বোবাকান্নাই কাঁদছে। অসহায় এই দু’টি মানুষের কান্না’র কারণে যাবার আগে প্রশ্ন করে ফেলি এই কান্না’র, এই চোখের জলের, এই যন্ত্রণার কি কোনই শাস্তি নেই। প্রতারক চক্র কি আইনের আওতায় আসবেনা, হবেনা বিচার?
এই রুহুল আমীন বা আমাদের বাহাদুর ভাইকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের অনেকেই চিনবেন। যারা শহীদ সাটু হল, এক সময়ের গুলশান মোড়, প্রেসক্লাব, ক্লাব সুপার মার্কেট, নিউ মার্কেট এলাকায় উঠাবসা করেন তারাতো চিনবেনই। পাতলা ‘খিটখিটে’ লোক এই বাহাদুর একজন প্রতিবন্ধি। কণ্ঠস্বরে আছে জড়তা। কথা বলেন জড়িয়ে জড়িয়ে। যখন হাঁটেন তখন তার শরীর টাল খায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মাস্টাররোলের কর্মচারী এই রুহুল আমীনকে সম্ভবত প্রয়াত আব্দুল মান্নান সেন্টু পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন প্রতিবন্ধিতার কারণেই শহীদ সাটু হলে হালকা কাজ হিসেবে সাটু হল ‘দেখাশুনার’ কাজ দিয়েছিলেন। এখনও তাকে দেখা যায় শহীদ সাটু হলে কিংবা পৌরসভায়।
এই বাহাদুরের মেয়ে ক্লাস টেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। সেও প্রতিবন্ধি। তার একটি চোখ নষ্ট। বাহাদুরের একটি মাত্র ছেলে সে আবার ‘বিপথগামী’। এ এক অসহায় জীবন যাপন। বর্তমানে বলা যায়, পরিবারের ‘বোঝা’ ওই প্রতিবন্ধি মেয়েটির কাছ থেকে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা।
প্রলোভন কিংবা ঘটনাটির সূত্রপাত কতদিনের তা জানা যায়নি। তবে, টাকা খোয়ানোর ঘটনাটি রোববার দুপুরের। ওই মেয়েটি জানায়, তাদের বাড়ির সেলফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে প্রতারক চক্র ফোন করে জানায় সে গ্রামীণ ফোনের আওতায় লটারিতে বিজয়ী হয়েছে। আর এর আওতায় আসতে হলে তাকে প্রথমে মাত্র ১শ টাকার ফ্লাক্সিলোড দিতে হবে। সেই লোড দেয়ার পর তার মোবাইলে একটি ভুয়া ফ্লাক্সিলোড’র ম্যাসেজ আসে। যাতে দেখা যায় ১৫ হাজার ৭ শ টাকার ব্যালান্স। মেয়েটিকে জানানো হয় যে, এই টাকা থেকে সে ৫ বছর ফ্রি কথা বলতে পারবে। সেই সঙ্গে জানানো হয় যে, সে লটারিতে গাড়ি বিজয়ী হয়েছে। গাড়ি না নিলে তাকে নগদ টাকা দেয়া হবে। এতেই প্রতারক চক্রের মোহের মধ্যে পড়ে ওই মেয়েটি। প্রতারক চক্রের কথানুযায়ী রোববার বাড়ির কাউকে কিছু না বলেই বাড়িতে থাকা এক হাজার টাকা নিয়ে নামো রাজারামপুর হালুয়াবান্ধা এলাকা থেকে শহরে চলে আসে। তারপর ক্লাব সুপার মার্কেটের সামনের বিকাশের দোকানে গিয়ে প্রতারক চক্রের দেয়া বিকাশ নম্বর ০১৭৩৫-২৪১১০৫ -এ ১ হাজার টাকা বিকাশ করে। তার মাত্র ৮/১০ মিনিট পরেই আবাও মেয়েটি বিকাশ দোকানে এসে ওই একই নম্বরে ৫ হাজার ১ শ টাকা বিকাশ করতে বলে। বিকাশে ওই টাকা ট্রান্সফার হওয়ার পরপরই তার ফোনে কল আসে। সে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কথা শেষ হলে দোকানের সামনের টুলে বসে পড়ে। দোকানদার টাকা চাইলে সে জানায়, টাকা নিয়ে আসছে। কে আসছে, জানতে চাইলে সে জানায় ‘আমি তাকে চিনিনা’। এই তুমি কাকে টাকা দিলা দোকানদারের প্রশ্নের জবাবে সে তার সেলফোনের একটি ম্যাসেজ দেখিয়ে বলে, ‘এই যে আমার মোবাইলে ম্যাসেজ এসেছে। ওরা আমাকে ম্যালাই টাকা দিয়ে যাবে’। ততক্ষণে বোঝা শেষ যে, মেয়েটি প্রতারক চক্রের খপ্পড়ে পড়েছে। এরপর খোজে খোজে বেরিয়ে আসলো  প্রতিবন্ধি মেয়েটি অসহায় প্রতিবন্ধি রুহল আমীন (বাহাদুর) এর মেয়ে। অসহায়ত্বের বিবেচনায় রাতে বিকাশ দোকানদার মেয়েটিকে তার বাবার সঙ্গে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
জানিয়ে রাখি, বাহাদুরের এখন আর শরীর তেমন চলেনা। পৌরসভাতেও বেতন এই আছে এই নেই। সংসারই চালানো দায়। অন্যের সাহায্য আর করুণায় কোনমতে সংসার চালান তিনি।
য্ােহাক, এরকম প্রতারণা দেশে অহরহই হচ্ছে। অনেকেই প্রচুর ্টাকা খুইয়েছেন প্রতারকদের হাতে। অনেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’র কাছে অভিযোগও করেছেন। কিন্তু প্রতারক চক্র ধরা পড়েছে, বড় শাস্তির আওতায় এসেছে এমন খবর গণমাধ্যমে খুব একটা চোখে পড়েনা। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় চোখে পড়ছে এতোট ককটেলসহ এতোজন আটক, এতাটি পেট্রোল বোমাসহ এতজন আটক। কোনভাবেই বলার চেষ্টা করছিনা যে, ককটেল কিংবা পেট্রোল বোমা ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু এরচেয়েও কি কম ক্ষতিকারক, অসহায় মানুষদের সঙ্গে এই প্রতারণা? শাস্তির আওতায় কি আসবেনা বাহাদুর ও তার মেয়ের বোবাকান্না’র পেছনের প্রতারকরা।