১০ জানুয়ারি, মহানায়ক ফিরে এলেন স্বদেশে ----------------- কায়ছার আলী
‘জয় বাংলা’ আসলেই একটি মন্ত্র। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ বা দাদা ভাই নওরোজীর ‘স্বরাজ’ বা গান্ধীজীর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা নেতাজী সুভাষের ‘চলো দিল্লী’ এ হল শব্দ ব্রক্ষ। একটি শব্দের বা শব্দের সমষ্টির মধ্যে অসীম শক্তি নিহিত। ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ তেমনি একটি স্লোগান বা চেতনা। যে স্লোগানে একাকার হয়ে মিশে আছে প্রতিটি বাঙ্গালির শিরায়, উপশিরায়। এখনও এই শব্দগুচ্ছ সমগ্র বাঙালিকে একাকার করে দেয়।
পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের দুঃশাসনের কারণে আপামর জনতার করুন আহাজারিগুলো স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু’র মহান হৃদয়কে আলোড়িত করে।
সত্তর এর দশকের শেষের দিকে তখন বাউলের একতারায় একটি নাম বঙ্গবন্ধু, মাঝির গাওয়া ভাটিয়ালিতে একটি নাম বঙ্গবন্ধু, বস্তাটানা কুলি-মজুরের কন্ঠেও একটি নাম বঙ্গবন্ধু, কিষাণের ভাওয়াইয়াতেও ফুঠে উঠে একটি নাম বঙ্গবন্ধু। সে কি আলোড়ন, সারাদেশব্যাপী সেকি হিন্দোল, এ যেন ছিল মহাসাগরের উত্থানের মত চারদিকে ভরপুর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু। এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তখন জাতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু এবং একমাত্র ঐক্যের প্রতীক এ পরিণত হলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর কন্ঠই সমগ্র শক্তির তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী। যুদ্ধের পূর্ব মুহুর্তে তরুন যুবকদের বুকে প্রচন্ড আবেগ, উদ্বেগ ও উত্তেজনা, শিশু কিশোরদের চোখে সীমাহীন কৌতুহল, বয়স্কদের চোখে-মুখে ভীতি, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ, নারীসমাজের বুক অজানা উৎকন্ঠায় প্রকম্পিত। এমনি পরিস্থতিতে বঙ্গবন্ধু শক্তভাবে দেশের হাল ধরলেন। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে লিঙ্কনের কথা অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক। লিঙ্কন দেশ ও জাতিকে চরম সংকট, গৃহযুদ্ধ ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে অভূতপূর্ব বিজয়ের সম্মান লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার পরেই তিনি নিহত হন। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা রূপে স্বাধীনতার ডাক দেন। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেন, দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেন এবং বিশ্বসভায় জন্ম দেন বাংলাদেশ নামক একটি নতুন স্বাধীন সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের। কিন্তু তারপর চার বছর না পেরুতেই তিনি নিহত হন। আরও একটি বিস্ময় বঙ্গবন্ধু ও লিঙ্কনকে একই সূত্রে বেধে দেয়। লিঙ্কনকে তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গে ভাষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা কষ্টকর। বঙ্গবন্ধুকে তার ৭ মার্চের ভাষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু একে অপরের সাথে এমনিভাবে জড়িত যেভাবে গাছ এবং শিকড়, সাগর এবং উর্মিমালা, ফুল এবং গন্ধ, আকাশ এবং সূর্য। কারণ এগুলোকে কখনো আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ২০০৪ সালে আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা তাঁর কন্যা বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলি পাঠ করে জানা গেল, এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীন অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন থাকে সদা তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও এই বইটি তার সাক্ষর বহন করেছে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বই, একটি জীবন, একটি ইতিহাস। বইটিকে বলা যায় বাঙালির ঘরের খোলা জানালা, রৌদ্র করোজ্জ্বল বারান্দা, উন্মুক্ত প্রাণময় উঠোন, বিস্তৃত শ্যামলা শস্যের মাঠ, শত শত ¯্রােতস্বিনী নদী, দূরের মনোমুগ্ধকর সবুজ পাহাড় আর ভালোলাগার বঙ্গোপসাগর। এ বইতে নদী মেঘলা মাটির গন্ধ আছে। মধুমতি
নদীর কাদা মাখানো আছে এবং বাইগার নদীর নিযাস আছে। টুঙ্গিপাড়ানামক অঁজগ্রামের আলো বাতাসের মৌ মৌ গন্ধ আছে। সেই গ্রামে মানব শিশু ছোট্ট খোকার জন্ম ও বেড়ে ওঠার নিবিড় বর্ণনা আছে। যে খোকা নিজেই তার কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের ভাষায়, নিজের ভালোবাসায়। স্মৃতি থেকে তুলে এনে জাদুকরী বর্ণনায় সত্যকে সুন্দর করে বলার এক অসম্ভব, অসাধারণ শব্দ গাথা এটি। কারাগারের বন্দী জীবনের নির্জন, বন্ধ, প্রকৃতির মায়াহীন, ছায়াহীন ঘরে বসে বেদনার্ত মনে কি করে এমন রূপময় বর্ণনায় বাঙালির মন, রূপ, রস, গন্ধ, আনন্দ, বেদনা আর এই ¯িœগ্ধ জননী-জন্মভূমির কথা সহজ সরল ও প্রবহমান ভাষায় নিজের আত্মকথনের মাধ্যমে তুলে ধরলেন, কিছুতেই ভেবে পাইনা। এতদিন যাকে জানতাম বাঙালির কান্ডারি, তাঁকে এখন বইটির মাধ্যমে আবিষ্কার করলাম ইতিহাসের এক রাখাল রাজা, এক অসাধারণ কথক হিসেবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন-
অনুবাদ: এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এই ঘোষনা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই রাতেই অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। রাত ১টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিনদিন পর তাঁকে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। তার আগে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহী ঘোষনা করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নি:শর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আর্ন্তজাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠানো হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছালে তাঁকে অবিস্মরনীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্য ভাষন দেন। পরিশেষে স্বাধীনতা অর্জন এবং মুক্তির লাল সবুজ পতাকা আমাদের এনে দেওয়ার ক্যারিজম্যাটিক নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর মুক্তিকামী বাঙালীদের বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বিজয়ের পরিপূর্ণতা আসেনা। তখন এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাবার আসায় ঘরে ঘরে রোযা রেখেছেন, বিশেষ দোয়া এবং প্রার্থনা করেছেন। মানুষের শক্তির কাছে আবারো পাকিস্তান সরকার পরাজিত হয়ে মিয়ানওয়ালি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের নিঃসঙ্গ বন্দীজীবন তথা মৃত্যুর মুখ এবং কবরের কাছ থেকে এই দিনে এক মাহেন্দ্রক্ষণে (দুপুর ১টা ৪১ মিনিট) হানাদারমুক্ত পবিত্র মাতৃভূমিতে নেমে বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ আমাদের দিলেন এবং ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।
লেখক ঃ শিক্ষক, ফরক্কাবাদ এন.আই স্কুল এন্ড কলেজ, বিরল, দিনাজপুর।
পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের দুঃশাসনের কারণে আপামর জনতার করুন আহাজারিগুলো স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু’র মহান হৃদয়কে আলোড়িত করে।
সত্তর এর দশকের শেষের দিকে তখন বাউলের একতারায় একটি নাম বঙ্গবন্ধু, মাঝির গাওয়া ভাটিয়ালিতে একটি নাম বঙ্গবন্ধু, বস্তাটানা কুলি-মজুরের কন্ঠেও একটি নাম বঙ্গবন্ধু, কিষাণের ভাওয়াইয়াতেও ফুঠে উঠে একটি নাম বঙ্গবন্ধু। সে কি আলোড়ন, সারাদেশব্যাপী সেকি হিন্দোল, এ যেন ছিল মহাসাগরের উত্থানের মত চারদিকে ভরপুর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু। এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তখন জাতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু এবং একমাত্র ঐক্যের প্রতীক এ পরিণত হলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর কন্ঠই সমগ্র শক্তির তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী। যুদ্ধের পূর্ব মুহুর্তে তরুন যুবকদের বুকে প্রচন্ড আবেগ, উদ্বেগ ও উত্তেজনা, শিশু কিশোরদের চোখে সীমাহীন কৌতুহল, বয়স্কদের চোখে-মুখে ভীতি, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ, নারীসমাজের বুক অজানা উৎকন্ঠায় প্রকম্পিত। এমনি পরিস্থতিতে বঙ্গবন্ধু শক্তভাবে দেশের হাল ধরলেন। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে লিঙ্কনের কথা অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক। লিঙ্কন দেশ ও জাতিকে চরম সংকট, গৃহযুদ্ধ ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে অভূতপূর্ব বিজয়ের সম্মান লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার পরেই তিনি নিহত হন। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা রূপে স্বাধীনতার ডাক দেন। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেন, দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেন এবং বিশ্বসভায় জন্ম দেন বাংলাদেশ নামক একটি নতুন স্বাধীন সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের। কিন্তু তারপর চার বছর না পেরুতেই তিনি নিহত হন। আরও একটি বিস্ময় বঙ্গবন্ধু ও লিঙ্কনকে একই সূত্রে বেধে দেয়। লিঙ্কনকে তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গে ভাষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা কষ্টকর। বঙ্গবন্ধুকে তার ৭ মার্চের ভাষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু একে অপরের সাথে এমনিভাবে জড়িত যেভাবে গাছ এবং শিকড়, সাগর এবং উর্মিমালা, ফুল এবং গন্ধ, আকাশ এবং সূর্য। কারণ এগুলোকে কখনো আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ২০০৪ সালে আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা তাঁর কন্যা বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলি পাঠ করে জানা গেল, এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীন অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন থাকে সদা তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও এই বইটি তার সাক্ষর বহন করেছে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বই, একটি জীবন, একটি ইতিহাস। বইটিকে বলা যায় বাঙালির ঘরের খোলা জানালা, রৌদ্র করোজ্জ্বল বারান্দা, উন্মুক্ত প্রাণময় উঠোন, বিস্তৃত শ্যামলা শস্যের মাঠ, শত শত ¯্রােতস্বিনী নদী, দূরের মনোমুগ্ধকর সবুজ পাহাড় আর ভালোলাগার বঙ্গোপসাগর। এ বইতে নদী মেঘলা মাটির গন্ধ আছে। মধুমতি
নদীর কাদা মাখানো আছে এবং বাইগার নদীর নিযাস আছে। টুঙ্গিপাড়ানামক অঁজগ্রামের আলো বাতাসের মৌ মৌ গন্ধ আছে। সেই গ্রামে মানব শিশু ছোট্ট খোকার জন্ম ও বেড়ে ওঠার নিবিড় বর্ণনা আছে। যে খোকা নিজেই তার কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের ভাষায়, নিজের ভালোবাসায়। স্মৃতি থেকে তুলে এনে জাদুকরী বর্ণনায় সত্যকে সুন্দর করে বলার এক অসম্ভব, অসাধারণ শব্দ গাথা এটি। কারাগারের বন্দী জীবনের নির্জন, বন্ধ, প্রকৃতির মায়াহীন, ছায়াহীন ঘরে বসে বেদনার্ত মনে কি করে এমন রূপময় বর্ণনায় বাঙালির মন, রূপ, রস, গন্ধ, আনন্দ, বেদনা আর এই ¯িœগ্ধ জননী-জন্মভূমির কথা সহজ সরল ও প্রবহমান ভাষায় নিজের আত্মকথনের মাধ্যমে তুলে ধরলেন, কিছুতেই ভেবে পাইনা। এতদিন যাকে জানতাম বাঙালির কান্ডারি, তাঁকে এখন বইটির মাধ্যমে আবিষ্কার করলাম ইতিহাসের এক রাখাল রাজা, এক অসাধারণ কথক হিসেবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন-
ÒThis may be my last message, from to-day Bangladesh is
independent. I call upon the people of
Bangladesh Wherever you might be and with whatever you have, to resist
the army of occupation to the last, your fight must go on until the last
soldier of the Pakistan
occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is
achieved.
লেখক ঃ শিক্ষক, ফরক্কাবাদ এন.আই স্কুল এন্ড কলেজ, বিরল, দিনাজপুর।