তাঁর হাত ধরে আসা, প্রাপ্তিটাও কম নয়----শহীদুল হুদা অলক

সালটা সম্ভবত ১৯৮৯ কিংবা ১৯৯০। তখন কলেজের ছাত্র। পড়তাম বাণিজ্য বিভাগে। ওই সময় আমাদের সরকারি কলেজে বণিজ্য বিভাগের শিক্ষক ছিলেন দীপক দাস। তিনি আবার অধ্যাপনার পাশাপাশি তৎকালিন রেডিও বাংলাদেশের নিউজ বিভাগের অনুবাদক ছিলেন। এখনও তিনি ওই দায়িত্ব পালন করছেন। ওই সময় আমার স্বর্গীয় পিতা অধ্যাপক জিকেএম শামসুল হুদা রেডিও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা ছিলেন। একদিন আব্বা আমার হাতে একটা হলুদ খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার দীপক স্যারকে দিয়ে দিও’। খামটা নিয়ে কলেজে আসলাম, খুলে দেখলাম তাতে চারটা পৃথক পৃথক সংবাদ লেখা আছে। ওই সংবাদগুলোর মধ্য থেকে দু’টা সংবাদ আমার নোট বুকে অবিকল তুলে নিলাম। অতঃপর খাম বন্ধ করে ক্লাসে গিয়ে দীপক স্যারকে খামটা ধরিয়ে দিলাম। তিনি খামটা দেখেই হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন তাই কোন কথা না বলেই তা টেবিলে রেখে আমাদের পড়াতে শুরু করলেন...।
কলেজ জীবনের শুরুতেই লেখালেখি’র ঝোঁক ছিল। কিন্তু কোন লেখাই আলোর মুখ দেখতো না। অর্থাৎ প্রকাশ হতো না। ওই সময় আনাসার ভিডিপির একটা প্রকাশনা ছিল ‘প্রতিরোধ’ তাতে লেখা পাঠাতাম। কিন্তু ছাপা হতোনা। হবে কেমন করে, আমি লিখতাম স্কুলের কিংবা অন্যান্য সমস্যা নিয়ে। আর ওই প্রকাশনা ছিলো ওই বাহিনীর কর্মকান্ড আর সরকারের ইতিবাচক বিষয় প্রকাশের একটা সরকারি প্রকাশানা। ছোট গল্প ও কবিতাও থাকতো। অবশ্য একটা সংখ্যায় আমাদের গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগে একমাত্র সড়ক (ধান্নু’র মোড়ের সড়ক) চলাচলের অনুপোযোগি বিষয়ক একটা লেখা ওই ‘প্রতিরোধ’-এ ছাপা হয়েছিল পাঠকের কলামে। এই লেখার ঝোঁক থেকে সাংবাদিকতার ঝোঁক, সেটা ছিল ছাত্রাবস্থা থেকেই। যাক, এবার আসি সেই হলুদ খামের দিকে।
আব্বার খাম থেকে যে দু’টা সংবাদ অবিকল আমার কলেজ নোট বুকে তুলে নিয়েছিলাম। সেই দুটিকে আমার খাতার কাগজে লিখলাম। আর আব্বা যেরকমভাবে তাঁর লেখা সংবাদের নিচের দিকে স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই রকমভাবে আমার খাতার কাগজে লেখা সংবাদের নিচে আমিও আমার স্বাক্ষর করে হলুদ খামে বন্দি করলাম। উদ্দ্যেশ্যে ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’য় জমা দেব সংবাদ দু’টি। পড়ার টেবিলে তা করলাম লুকিয়ে লুকিয়ে... বাড়িতে যেন কেউ বুঝতে না পারে। অবশ্য, ওই যাত্রায় কেউ বুঝতেও পারেননি।
তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে রমারমা অবস্থা ‘সাপ্তাহিক নবাবগঞ্জ বার্তা’র। সরকারি ছাড়পত্র নিয়ে বের হওয়া একমাত্র পত্রিকা। মানুষের চাহিদা প্রচুর। অভিযানে নামলাম ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’র অফিস অনুসন্ধানে। শুনলাম বড় ইন্দারা মোড়ের কাছে ছাপা হয় ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’। খোজে খোজে গেলাম বড় ইন্দার মোড় পেড়িয়ে মর্ডান প্রেসে। সেখানে জানানো হলো এখানে ছাপা ঠিকই, কিন্তু অফিস তার এটা নয়। তার বাড়ি হচ্ছে ডোমপাড়া’র (কলোনীপাড়া) কাছে। হলুদ খামটা হাতে নিয়ে হাটলাম ডোমপাড়ার দিকে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে এলাম ডোমপাড়ার উত্তরপার্শ্বের একটা পায়ে হাঁটা সরু পথে। সেই পথ ধরে একটু এগুতেই একটা দ্বোতালা বাড়ি। একজন বললেন, নাজাত সাংবাদিক এই বাড়িতেই থাকেন। বাড়িটির কেঁচিগেট তালা দিয়ে বন্ধ। কেঁচিগেটের পাশে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুধু একটা সিড়ি’র কয়েকটি ধাপ আর সিড়িঘরের নিচে অব্যবহৃত আবসবাপত্র পড়ে থাকতে দেখলাম। কোন মানুষের দেখা পেলাম না। পেলামনা কোন সাড়া শন্দও। হতাশ হয়ে হাতে থাকা হলুদ খামটি স্বজোরে ছুড়ে মারলাম সিড়ি বরাবরে। তারপর হাঁটা ধরলাম বাড়ির পানে...। লেখা ছাপার সুপ্তবাসনা নিয়ে আরো একবার গিয়েছিলাম ওই বাড়িটিতে। কিন্তু সেবারও একই অবস্থা কেঁচিগেট বন্দি সিড়িঘর...
একদিন, দু’দিন করে যেন ভুলেই গেছিলাম হলুদ খামের কথা। হটাৎ একদিন সকাল বেলা। সম্ভবত ১০টা সাড়ে ১০টা হবে। বাড়ি টেলিফোনটি বেজেই চলেছিল।
রিসিভারটি তুলে হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করলেন ‘হুদা ভাই নেই’।
আমি বললাম, ‘আব্বা বেড়িয়ে গেছেন’।
-ও আচ্ছা, ‘তোমার আব্বু আসলে বলিও, নাজাত চাচ্চু ফোন করেছিল’।
আমি বলাম কে!
তিনি বললেন, ‘বলবা নাজাত চাচ্চু ফোন করেছিলেন’।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নাজাত হোসেন বলছেন। তিনি বলেন, হ্যাঁ।
তখন আমার এক রোমাঞ্চকর অবস্থা। সম্পাদক নাজাত হোসেন আমাদের বাসায় ফোন করেছেন!
আমি বিন্দুমাত্র দেরি না করে আমার হলুদ খামের কথা বলে বসলাম। বলাম, চাচা আমি দু’টা সংবাদ আপনার বাসায় দিয়ে এসেছি।
তিনি বললেন, তাই নাকি। আচ্ছা তোমার নাম কি?
আমি বললাম, অলক।
এই নামে তো কোন সংবাদ দেখিনি, আচ্ছা ঠিক আছে বলে তিনি টেলিফোনটি রেখে দিলেন।
তাঁর টেলিফোন রেখে দেয়া আমাকে অপূর্ণতা ঘিরেই রাখলো।
কয়েক দিন পর, তখন সন্ধ্যা বেলা। উদয়ন সিনেমা হলের আনন্দ বুক স্টল থেকে আগে যেভাবে ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’ কিনতাম। সেইদিনও একটা ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’ কিনলাম। পত্রিকা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হটাৎ চমকে উঠলাম। পেছনের পাতা বামদিকের উপরের অংশে এক কলামে আমার হলুদ খামের ভেতরে থাকা দু’টা সংবাদের একটা ছাপা হয়েছে। ওই সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘ রাকাবের কৃষি ঋণ বিতরণ’। তার নিচে যেখানে স্টাফ রিপোর্টার কিংবা নিজস্ব প্রতিবেদক বা সংবাদদাতা ইত্যাদি লেখা থাকে সেখানে লেখা তিন অক্ষরের একটা ছোট্ট নাম ‘অলক’। এ এক অন্যরকম অনুভুতি। পাঠক মনে করিয়ে দেই, আমার আব্বার সংবাদ অবিকল লেখার সময় আব্বার মত আমি শুধুই আমার স্বাক্ষর করেছিলাম। তাতে আমার কোন নাম লেখা ছিলনা। কাজেই তিনি ( সৈয়দ নাজাত হোসেন) টেলিফোনে শোনা নামটাই লিখে দিয়েছিলেন সংবাদের ‘ক্রেডিট’ লাইনে।
এরপরই জড়িয়ে গেলাম ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’র সঙ্গে, সৈয়দ নাজাত হোসেনের সঙ্গে। প্রায় একই সময় যুক্ত হয়েছিলেন সহকর্মী আমিনুল ইসলাম। সম্ভবত জোনাব আলীও। মাত্র কয়েক মাস কাজ করেছিলাম সেই ‘কেচিগেট বন্দি’ বাড়িতে। এরপর অফিস হয় শহীদ সাটু হলের একটি কক্ষে (এখন যেটি উদীচী’র অফিস)। এই শহীদ সাটু হলের ঘরে এবং বালুবাগানের অফিসে কয়েক বছর কাজ করেছি এবং সানিধ্যে থেকেছি নাজাত চাচা’র।
আমরা যখন ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’র সঙ্গে কাজ করতাম পত্রিকাটি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের কাছে অত্যান্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ’। জেলায় একটি মাত্র পত্রিকা, সেটি সাপ্তাহিক হলেও পরের সপ্তাহে কি ছাপা হয় তা জানার জন্য পত্রিকা প্রকাশের নির্ধারিত দিনের পরের দিন থেকেই মানুষের চরম আগ্রহ থাকতো। মানুষের এই অবস্থা সৃষ্টির নায়কই ছিলেন সৈয়দ নাজাত হোসেন।
সেই সময় বহু আলোাচিত সংবাদ, ঘটনা আছে ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’কে ঘিরে। সংবাদের বাইরে ওই সময় খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল জামায়াতের তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খানের একটি সাক্ষাৎকার। তিনি বহু কষ্ট করে এবং নানাভাবে জামায়াত নেতাদের ম্যানেজ করে আব্বাস খানের র্দীঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। যা পরের সংখ্যায় বড় যায়গাজুড়ে প্রকাশ হয়েছিল সাক্ষাৎকারটি। ওই সাক্ষাৎকারটিতে তুলে ধরা হয়েছিল নানা ‘প্রিয়-অপ্রিয়’ কথা। হালে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা খুবই সহজ। টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার রেকর্ড করার পর তা লিপিবদ্ধ করার আগে সাক্ষাৎকার নিতে ব্যবহার করা হতো শুধুই কাগজ আর কলম। তিনি ওই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ওই কাগজ-কলম দিয়েই। পরে তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন সাক্ষাৎকার নেয়ার নানান দিক। প্রশ্ন নির্বাচন, তারপর উত্তর গ্রহণ। উত্তরের বিপরীতে সম্পুরক প্রশ্ন করা ইত্যাদি।
প্রতি সপ্তাহের ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’ পাঠকের হাতে তুলে দিতে এর পেছনে ছিল অনেক কষ্ট গাঁথা। নবাবগঞ্জ বার্তা’র আমার প্রথম সংবাদটি ছাপা হয়েছিল লেটার প্রেসে। পরে যখন কাজ শুরু করি তখন তা চলে আসে অফসেট প্রেসে। স্ক্রীপ্ট লিখে নিয়ে রাজশাহী গিয়ে কম্পিউটর কম্পোজ, ট্রেসিং পেপার নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফিরে এসে তা পেস্টিং করে আবারও রাজশাহী গিয়ে ছাপিয়ে নিয়ে আসা। তারপর পাঠকের হাতে...। সৈয়দ নাজাত হোসেন ও তার সঙ্গে আমরা যারা ছিলাম তাদের এত কষ্ট ম্লান হয়ে যেত প্রয়াত কুদ্দুস ভাই যখন বাজারে বাজারে চিৎকার করে বলতো ‘বমভাটাম’ আর আলতাফ ভাই যখন বলতো ‘তাজাখবর’।
এখন প্রতিদিন বড় আকারের দৈনিক পত্রিকা বের হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। আর তখন সপ্তাহের কাগজ তাও আবার ট্যাবলয়েড সাইজ তাতেই সংবাদ আর লেখা জোগারে আমারা হীমসিম খেতাম। সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে বাজারে পত্রিকা বিক্রি হচ্ছে তখন সম্পাদকের চেয়ারে বসে নাজাত চাচা আমাদের কাছে জানতে চাইছেন আগামী সপ্তাহের জন্য কে কোন সংবাদ করবে। অর্থাৎ পত্রিকা বের হওয়ার পর একদিন, দু’দিন ‘আরাম’ পাব তার সুযোগ তেমনটা ছিলনা। প্রতি সপ্তাহেই তিনি আমাদের নিয়ে বসে সংবাদ নিয়ে আলোচনা করতেন এবং নিবিরভাবে গাইডলাইন দিতেন। আমার একটা দু’টা স্টোরি করতাম। বড় বড় স্টোরিগুলো তিনি নিজেই করতেন। তাঁকে দেখতাম আগে থেকে তিনি কোন সংবাদ লিখে রাখতেননা। তাঁর মাথায় থাকা সংবাদগুলো একরাতে বসে সব লিখে ফেলতেন।
আগেই বলছিলাম নিবিরভাবে গাইড লাইন দিতেন, কোন সংবাদ কি কিভাবে করবো তা তিনি বুঝিয়ে দিতেন এবং ভুলভ্রান্তিগুলো সুন্দরভাবে ধরিয়ে দিতেন। এইভাবেই আমার ‘কাঁচা’ থেকে অর্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
তাঁর উৎসাহে নবাবগঞ্জ বার্তায় ‘প্রতিচ্ছবি’ নামে একটি কলাম সৃষ্টি করেছিলাম। পেছন পাতায় দু’ কলামে নিয়মিত আমার নামে ছাপা হত নানান প্রতিবেদন। ওই সময় মানুষের যোগযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম টেলিফোন। এখনতো সেলফোনের যুগ তখন ওই টেলিফোন নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের নানান অভিযোগ আসছিল আমাদের কাছে। দিনের দিন টেলিফোন নষ্ট থাকলেও তা সচল করা হতো না, ঠিকমত লোকজন পাওয়া যায়না ইত্যাদি। এবিষয়ে প্রতিবেদন করার চিন্তা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্চে গিয়ে দেখি ‘অভিযোগ ও অনুসন্ধান’র কক্ষটিতে কোনই লোক নেই। ওই কক্ষের টেলিফোন বোর্ডের (ওই বোর্ডে কড ঢুকিয়ে কথা বলতে হতো) সামনের চেয়ারটি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। অভিযোগ খাতাটিও অনেকটা অবহেলায় পড়ে রয়েছে। হাতে ছিল ক্যামেরা সুন্দর করে ছবি তুললাম। ক্যামেরা ফ্রেমে ধরা পড়লো লোকশূন্য টেলিফোন বোর্ডে, চেয়ার আর এক্সচেঞ্জের ‘হিজিবিজি’ তার। পরের দিনে অফিসে এসে নাজাত চাচাকে বিষয়টি বলতেই তিনি প্রসংশা করলেন। আর বললেন, ‘স্টোরিটা হার্ড। এটা সামনের পাতায় দেয়া যেতে পারে। যাক তুমি তোমার ‘প্রতিচ্ছবি’ কলামেই দেও’। ওই প্রতিবেদনটি নবাবগঞ্জ বার্তায় প্রকাশের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের দেয়ালে টাঙ্গানো হয় কালো টিনে সাদা হরফে লেখা একটা ঘোষণা। যাতে লেখা ‘ছবি তোলা নিষেধ’। সম্ভবত এখনও সেই কালো টিনটি এক্সচেঞ্জের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে।
একটি হুবাহু প্রতিবেদন বই আকারে প্রকাশ হওয়া বিষয়ে প্রতিবদন করতে গিয়ে তিনি আমাকে যথেষ্ট খাটিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যথাযথ ‘রেফারেন্স’, সূত্র এবং কোন বইয়ের কত নম্বর পৃষ্টায় কি আছে তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন লিখতে হবে তবেই তা প্রকাশ হবে’।
সাংবাদিকতায় তাঁকে দেখেছি, সমাজের চিত্র তুলে ধরতে, সমস্যা তুলে ধরতে তিনি ‘মাঠে-প্রান্তে’ ছুটে বেড়িয়েছেন। আমাদেরকেও যেতে বলেছেন।
সৈয়দ নাজাত হোসেন তাঁর ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’র মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রচুর ইতিবাচক কাজে যেতে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করেছেন। তার তালিকা হবে বিস্তর। একটি জনগুরুত্বপুর্ণ বিষয়, সেটি হচ্ছে বারঘরিয়া বাজারকে ঘিরে। মহারজাপুরের জোনাব আলী তখন আমাদের সঙ্গে কাজ করতেন। ওই সময় বারোঘরিয়া বাজারের একেবারেই পশ্চিমপ্রান্তে মহানন্দার কোল ঘেষে স্থাপন করা হয়েছিল কয়েকটি ইটের ভাটা। ইটভাটা স্থাপন মানেই মাটি খোড়া। আর তার জের ধরে ভাঙ্গনের মুখে পড়তে পারে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী বারঘরিয়া বাজারসহ আশের বহু স্থাপনা। পাঠক, একটু খেয়াল করুন আমাদের মহানন্দা নদীর যে রেখা তা বারঘরিয়া পয়েন্টে সামান্য বাঁক রয়েছে। তাতে ভাঙ্গনের শংকা থাকে জোরালো। এই সার্বিক বিষয় নিয়ে নবাবগঞ্জ বার্তায় একটা জোনাব আলীর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। টনক নড়ে ছিল সংশ্লিষ্টদের। ইটভাটা উঠে চলে গেছে বারঘরিয়া বাজারের উত্তর-পুর্বকোণে। ইতিবাচকের এমন তালিকা দীর্ঘ দেয়া যাবে।
কেউ কেউ অনেক আলোচনা করেন। একথা সত্য দোষে গুণেই মানুষ। সৈয়দ নাজাত হোসেনের ভুল ত্রুটি ছিলনা এমনাটাতো হলফ করে বলা যাবেনা। তবে, আমি যতদিন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি তাতে আমার তৈরী করা কোন সংবাদ বা প্রতিবেদন তিনি ‘অশুভ ইশারায়’ তা ‘কিল’ করে দিয়েছেন। মিথ্যে কথা নয়, সত্যিই বলছি এমনটা মনে পড়ছেনা।
সৈয়দ নাজাত হোসেনের সংবাদ লেখার একটা নিজস্ব একটা ভঙ্গি ছিল। তিনি একটি বাক্য লেখার পর পরের বাক্যে ‘অর্থাৎ’ শব্দযোগ করে বিষয়টি পরিস্কার করে দিতেন।
তাঁর সানিধ্যে থাকার কারণে তাঁর একটা অভ্যাস আমার কাছে চলে আসে। তিনি কোন কিছু নোট নেওয়ার সময় যখন নোট নিতেন তখন ছোট ছোট অক্ষরে তাঁর নোটবুকে ‘বাঁকা’ করে লিখতেন। নোটবুকের বাম সাইডে উপরের অংশ নিচে ডান সাইডের অংশ ফাঁকায় থাকতো চলে যেতেনে পরের পাতায়। আমার নোট নেয়ার অবস্থাও একই। সোজা লাইন করে লেখার চেষ্টা করেও লাভ হয়না, বাঁকাই হয়।
আমরা যারা তাঁর সঙ্গে কাজ করতাম আমাদের সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধু সুলভ আচরণ। আবার কারো প্রতি বেশী বিরক্ত হলে ইংরেজিতে গালি দিতেন ‘স্টুপিড’।
আমি যতদিন তার সঙ্গে কাজ করেছি ততদিনই তা করেছি কোন রকম সম্মানি বা পারিশ্রমিক ছাড়াই। তিনি তা দিতেও পারতেন না। কারণ ওই সময় দেখেছি, কম্পিউটারের ট্রেসিং আনতে কিংবা পত্রিকার ছাপাতে মিঠু বা সেন্টু আংকেলকে রাজশাহী পাঠাতেন ‘জোটিয়ে-জাটিয়ে’ টাকার জোগার করেই। বলছিলাম বন্ধু সুলভ আচরণের কথা। একটা বিষয় বারবার মনে পড়ছে। একটা সংখ্যায় আমার একটা নিজ নামে প্রতিবেদন ছিল। ওই সংখ্যার জন্য আরো একটা প্রতিবেদন তৈরী করেছিলাম। পরের প্রতিবেদনটিতে ক্রেডিট লাইনে লিখেছিলাম ‘অলক মিত্র’। আমার প্রকৃত নাম এটা না হওয়ার পরেও তাঁকে যখন আমার ‘ছেলেখেলামু’টা বললাম, তিনি মৃদু হেসে বললেন ‘এই নামে দিতেই হবে। আচ্ছা দেও’।
বড় সংগ্রাম করে ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’র এগিয়ে যাওয়ার পথে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের তালিকায় যুক্ত হয় আরো কয়েকটি সংবাদপত্র। নাজাত চাচা ওই সংবাদপত্রগুলো মধ্যে দু’একজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। তখন অবশ্য আমি আর ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’য় ছিলাম না।
সাংবাদিকতা’র একটা প্রবাহ আমার জীবনে যুক্ত পারিবারিকভাবেই। আমার ভাইজন (পিতামহ) মরহুম মাওলানা হেশামু্িদ্দন ‘মাসিক মোসলেম জাহান’ নামে পত্রিকা বের করতেন। আর আব্বাও ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও রেডিও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি। তবুও আমার সাংবাদিকতা যেহেতু শুরু ‘নবাবগঞ্জ বার্তা’ দিয়ে তাই আমার সাংবাদিকাতর শিক্ষাগুরুই হচ্ছেন সৈয়দ নাজাত হোসেন। তাঁর হাত ধরেই আসা এবং সাংবাদিকতায় অর্জনটাও অনেক। যদিও আমার সাংবাদিকতার বিস্তৃতিটা এনে দিয়েছেন অগ্রজ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন দিলু।
‘নবাবগঞ্জ বার্তা’য় প্রায় তিন/চার বছরের মত কাজ করলেও দীর্ঘ ২৫ বছর একই পেশায় থেকে ( মাঝে মধ্যে দু’ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া) নাজাত চাচার সানিধ্যেই ছিলাম। তিনি টেলিভিশন সাংবাদিকতার যুক্ত হওয়ার পর প্রযুক্তি বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করার সুযোগ হয়েছিল আমার। আজ সেই সহযোগিতা করার সুযোগটুকু থেকে বারবার মনে উচ্চারিত হচ্ছে ‘কিছুটা হলেও ঋণ শোধ করেছি’।
একটি বিষয়, এই মাত্র ‘ক’দিন’ আগেও তিনি ইন্টারনেট বা এসংক্রান্ত বিষয় বুঝতেন না। কিন্তু তাকে দেখেছি, বিষয়টি বুঝে নেয়ার পর তিনি ছিলেন খুবই ‘এ্যাকটিভ’। সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে তার উপস্থিতি ছিল ‘সরব’। কয়েক মাস আগে ঢাকায় গেছিলাম। ঢাকা’র ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলাম। তিনি দেখামাত্র লিখেছিলেন, ‘কিরে ব্যাটা, ঢাকায়? আমার বাড়ি চলে এসো, মিরপুরে..’
আজ সৈয়দ নাজাত হোসেন নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছেন নাজাত চাচা। আর শুনতে পাবোনা মধুর ডাক, ‘কিরে ব্যাটা...’।