ফলের পর প্রথমবারের মত সবজি ক্ষেতে ব্যাগিং প্রযুক্তি

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম বাগানে এ বছর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন এ জেলার আম চাষী ও বাগান মালিকরা। যার সুফলও পেয়েছেন তারা, তদের উৎপাদিত আম জায়গা করে নেয় ইংল্যান্ডের মার্কেটে। তবে নতুন খবর হলো, আম বাগানের পর এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবজি ক্ষেতে ব্যবহৃত হচ্ছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের ঢুলিপাড়া গ্রামে বেগুনের ক্ষেতে প্রথম বারের মত এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন আসলাম মিয়া নামে এক উদ্যোক্তা। তিনি গতানুগতিক বেগুন চাষ করলেও এ বছরই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশ সাড়া পেয়েছেন। তার ক্ষেতের ব্যাগিং প্রযুক্তির বেগুন ইতি মধ্যেই রাজধানী ঢাকায় যাচ্ছে। এছাড়াও অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে তার ক্ষেত থেকেই স্থানীয় বাজারের চেয়ে কেজিতে অন্তত ৫টাকা বেশি দিয়ে সংগ্রহ করছেন।
মাঠ পর্যায়ে প্রথম বারের মত চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেগুনে ব্যাগিং প্রযুক্তি সম্প্রসারণে কাজ করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ব্যাগিং প্রযুক্তির প্রধান গবেষক ড. মো. শরফ উদ্দিন। বেগুনের অতি মাত্রায় পোকামাকড়ের আক্রমনের বিষয়টি উল্লেখ করে এভাবেই বলছিলেন, কৃষিকে যারা একটু কাছে থেকে দেখেন বা মোটামুটি সচেতন তারা জানেন বিভিন্ন জাতের সবজিতে বিশেষ করে বেগুনে কীটনাশকের প্রয়োগের মাত্রা। কখনও কখনও শোনা যায় বেগুন চাষীরা প্রায় প্রতিদিনই বেগুনে কীটনাশক ব্যাবহার করে থাকেন। এরপরও ২৫-৩০% বেগুন নষ্ট হয় বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমনে। এই সমস্যা থেকে উত্তোলনে ব্যাগিং প্রযুক্তি একটি কার্যকর উপায়।
শুক্রবার শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের ঢুলিপাড়া গ্রামের ওই বেগুন ক্ষেতে গিয়ে কথা হয়, এর উদ্যোক্তা শ্যামপুর শরৎনগর মিয়াপাড়ার আসলামের সাথে। তিনি জানালেন, তিনি এবার প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে বেগুনের আবাদ করেছেন। তিনি বলেন-বেগুনের প্রধান শত্রু হলো পোকা, আর এই পোকার কারণে আমরা অনেক সময় বেগুন বিক্রি করতে পারি না। অনেক সময় বেগুন কম দামে বিক্রি করতে হয়। এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য আমি উপায় খুজছিলাম। এরকম সময়ে শ্যামপুরে আম বাগান দেখতে এসেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণা কেন্দ্রের ড. শরফ উদ্দিন নামে এক গবেষক। তাকে আমার বেগুন ক্ষেতের পোকার সমস্যার কথা বললে তিনি আমাকে বলেন, তিনি আমের পোকা সমস্যার উপর গবেষণা করেছেন, সেখানে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে আম বাগান মালিকরা। তার পরামর্শে পরে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করি। তিনি বলেন আমি প্রথমে সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই মাত্র ১টি বেগুনে ব্যাগিং করেছিলাম। মনে করেছিলাম বেগুনটি পচে যাবে কিন্তু ৬ দিন পরে দেখি অন্যান্য বেগুনের মতই আছে। এরপর ১০ টি এবং পরে আমি ১০০ টি বেগুনে ব্যাগিং করি এবং দেখতে পাই কোন ধরণের বালাইনাশকের ব্যবহার ছাড়াই ভালমানের বেগুন উৎপাদন করা সম্ভব। তিনি বলেন এই প্রযুক্তিতে বালাইনাশক স্প্রে করার প্রয়োজন নেই, ফলে স্প্রে খরচ বেঁচে যাচ্ছে।
এই উদ্যোক্তার কাছে প্রশ্ন ছিল, তিন টাকা দামের একটা ব্যাগ ব্যবহার করে এই বেগুন উৎপাদন কতটা লাভজনক। এর উত্তরে আসলাম জানান, আমি প্রথমে ১০০ টি ব্যাগ নিয়েছিলাম ৩০০ টাকায়, একটা বিষয় হলো, প্রতিটি ব্যাগ আমি বহুবার ( ছিড়ে না যাওয়া পর্যন্ত) ব্যবহার করতে পারছি। তিনি জানান বালাইনাশকের খরচের চেয়ে এই ব্যাগিং প্রযুক্তি অনেক সাশ্রয়ী। সেই সাথে বিশ মুক্ত সবজির চাহিদা বেশি, দামও ভালো পাচ্ছি। এপর্যন্ত প্রায় ৮০হাজার টাকা খরচ হয়েছে , ইতি মধ্যেই ব্যাগিং ছাড়া বেগুন প্রথমে প্রায় ৪০ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করেছি। এখন প্রতিমন বেগুন ৮শ-১ হাজার টাকা দরে বিক্রি করছি। আশা করছি ভালো লাভবান হব এবার বেগুন চাষ করে।
এবছর ১০০ টা ব্যাগ নিয়ে শুরু করেছি, আস্ত আস্তে ব্যাগের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী বছর আরো বেশি জমিতে আমি এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেগুনের আবাদ করবেন বলে জানান শ্যামপুর ইউনিয়নের এই বেগুন চাষী।
আসলামের বেগুন ক্ষেত থেকে ফ্রুট ব্যাগ প্রযুক্তির উৎপাদিত বেগুন কিনতে ঢাকা থেকে এসেছেন ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। তিনি জানালেন, তিনি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি উৎপাদিত পণ্য কিনে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে “কৃষক থেকে ভোক্তা” বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্যামপুর ইউনিয়নে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির এ বেগুন চাষের বিষয়ে জানতে পেরে আমি গতকাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকা থেকে এসেছি। তিনি বলেন ভালো পণ্যের চাহিদা রয়েছে সবার কাছে। মানুষ প্রয়োজনে বেশি দাম হলেও  বিষমুক্ত ভালো মানের ফল কিংবা সবজি খেতে চায়। আমি ব্যাগিং করা বেগুনগুলো নায্য দামে ক্রয় করে আমার উত্তরার বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রয় করবো। আমার মতো আরো কিছু দোকান আছে যেমন আগোরা,স্বপ্ন, গ্রামিন, সোপ এন সেভ যারা বিষমুক্ত ভালমানের ফল ও সবজি ক্রয় করে থাকে। সুতরাং আমাদের চাহিদা প্রচুর। চাষীরা উৎপাদন করলে সে নায্য মূল্যে পাবে। তিনি আরো জানান, তিনি  নাটোর পাবনা ও সিরাজগঞ্জে এ পদ্ধতিতে বেগুন চাষ সম্প্রসারনে কাজ করবেন।
এই বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ব্যাগিং প্রযুক্তির প্রধান গবেষক ড. মো. শরফ উদ্দিন জানান,  তিনি প্রথমে এই প্রযুক্তিটি শুরু করেছিলেন বিভিন্ন জাতের আমে। পরবর্তীতে পেয়ারা, ডালিম, কলা ও লিচুতে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এবার গুরুত্বপূর্ণ সবজি বেগুন এর ব্যবহার সফল হলো। যার ফলে বেগুনে প্রয়োজন হবে না প্রতিদিন বালাইনাশকের ব্যবহার।
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেগুনে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়ার জন্য কিছু নিয়ম কানুন অনুসরণ করার কথা বলেন বলেছেন ড.শরফ উদ্দিন । তিনি বলেন একটি বেগুনের বয়স দুই থেকে তিন দিন হলেই ব্যাগটি পরানো উচিৎ। বেগুনের বয়স যত বেশি হবে পোকায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। ব্যাগিং এর নিয়ম আমের মতোই। কুয়াসার পানি শুকিয়ে গেলেই একটি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে বেগুনের জমিটি ভালোভাবে ¯েপ্র করতে হবে। বেগুনের গায়ের পানির ফোঁটা না শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একটি বিষয় ভালোভাবে খেয়াল করতে হবে যে আজ যে বেগুনগুলি ব্যাগিং করা হয়েছে সেগুলো কতদিন পর সংগ্রহ করা হবে। ধরুন ৮ দিন পর সংগ্রহ করা হবে। এখন প্রথম দিন যতগুলো বেগুনে ব্যাগিং করা হবে সেই ব্যাগগুলিতে একটি সাংকেতিক চিহ্ন যেমন ১ লিখুন। আর এই ১ লিখা ব্যাগগুলি ৮ দিন পর সংগ্রহ করুন। আবার ২ দিন পরে যে বেগুন গুলিতে ব্যাগিং করা হবে সেগুলিতে ২ লিখুন এবং ৮ দিন পর ২ খিলা ব্যাগগুলির বেগুন সংগ্রহ করুন। এইভাবে পর্যয়িক্রমিকভাবে ব্যাগিং করুন এবং সংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সময়ে সংগ্রহ করুন। তবে জাতভেদে বেগুন সংগ্রহ করার সময় আরও বেশি হতে পারে। তুলনামুলকভাবে নিরাপদ ও বিষমুক্ত বেগুন উৎপাদন করা সম্ভব। এই গবেষক চাষীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, এই ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি এখন হাতের কাছে। চাইলে কেউ আমোদের সাথে পরামর্শ করে অন্যান্য ফল-ফসলে ব্যবহার করতে পারবেন।
গবেষকরা আশাবদী বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সবজি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, আর এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেগুন উৎপাদন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের বেগুনও স্থান করে নেবে বিশ্বের নামী দামী চেইন সপে।


চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ সফিকুল ইসলাম সফি,নিজস্ব প্রতিবেদক, শিবগঞ্জ/

,