বীরকন্যা প্রীতিলতা, ইলামিত্র এবং বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি-----মোঃ কায়ছার আলী

“জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান, মাতা-ভাগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান। কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে।” বিদ্রোহী কবি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রানভয় তুচ্ছ করে বাঙ্গলী মাতা, বধু ও ভগ্নী, খাওলা, খালেদা, লক্ষী বাই, চাঁদ সুলতানা রাজিয়া প্রমুখ ইতিহাসে যারা অমর ধন্যা তাদের জন্যই এ বাণী লিখেছিলেন। শতাব্দী অতীত, তবুও তাদের স্মৃতি অমলিন, বীরাঙ্গনা, বীরকন্যা ও বীরনেত্রী রূপে। তাদের গৌরবে ও সৌরভে পরবর্তী প্রজন্ম আজ ধন্য। সাহসে, বীর্যে, সংগ্রামে, সংকটে, আমাদের দেশের মেয়েরা যে কত মহিমাময়ী, মক্তিময়ী, সাহসিকা, বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর একজন জ্বলন্ত উদাহরণ। ১৯১১ সালের ৫ই মে তিনি চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হিন্দু লোকাচার মতে মেয়ে আর ছেলে জন্মালে বিভিন্নতা আছে। ছেলে জন্মালে পাঁচবার আর মেয়ে জন্মালে তিনবার উলু দেওয়া হয়। কন্যা সন্তান আবির্ভাবে মেয়েরা, মায়েরা, বোনেরা অর্থাৎ নারী জাতির কেউই সুখী হয়না। আবার গায়ের রং কালো হলে অভিভাবকেরা যেন বিপাকে পড়ে যান। ছোটবেলায় তার মা তাঁকে দেখে স্বামীকে বললেন, আমার কালো মেয়ে দেখ একদিন তোমাদের মুখ আলো করবে।” এ কথা বলেই ছোট্ট কাঁথায় জড়ানো এই নতুন মানুষটিকে মা বুকে জড়িয়ে চুমু দেন এবং আদর করে নাম রাখেন রাণী। প্রীতিলতা সহপাঠীদের বলত, “তোমরা আমাকে রাণী ডাক। নাটোর আর ঝাঁসীর রাণী যা পেরেছিল চাঁটগার রাণী ও তা পারবে।” ছোটবেলা থেকেই সে প্রতি শ্রেণীতে প্রথম তিনজনের মধ্যেই থাকত। এজন্য সে সকলের ভালোবাসা পায়। সেসময় ইংরেজ সাহেবদের অত্যাচার স্বচক্ষে সে দেখেছে। আর বই পড়ে জেনেছে, শোষণের হাড় ও রক্ত দিয়ে মুনাফায় যে র্স্ব্গ সৌধ ব্রিটেন গড়ে তুলেছে, তার কাহিনী। মাত্র ১৮ বছর বয়সের ছেলে ক্ষুদিরামের করুণ আকুতি ভরা ফাঁসির গান “একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পড়ব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী”। আর ভাবত এরা নিশ্চয়ই চোর ডাকাত নয় ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই তারা এ কাজ করছে। ঝাঁসীর লক্ষীবাই, ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, বাঘাযতীন, দেশের কথা, সরকারি রাউলাট কমিশনের রির্পোট ইত্যাদি নিষিদ্ধ বই গোপনে পড়তেন। মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ, আই.এ তে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান এবং কলকাতার বেথুন কলেজে দর্শনে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম হন এ বিপ্লবী নারী। বিপ্লবীদের স্লোগান ছিল “কর্ম আর মৃত্যু চাই, প্রশ্ন করার কিছু নাই”। দেশী-বিদেশী মহান বিপ্লবীদের জীবনী পড়ে তিনি জেনেছেন বিপ্লবীরা অপরাজয়, অপ্রতিরোধ্য, শির নত করে না, কখনো দমে না, আর শাসকদের চরিত্র বদলায় না। সে সময় তার সাথে ছিল কল্পনা দত্ত, সরোজিনী পাল ও কুমোদিনী রক্ষিত। নাটোরের রাণী ভবানী এবং তার একশ বছর পর লক্ষ্মীবাই বীরত্বের জন্য আজও ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শহীদদের এই রক্তস্রোত মিশ্রিত আতœদান কোনদিন ব্যর্থ হবে না এবং বিপ্লবের মাধ্যমেই দেশে মুক্তি আসবে। সেই বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পন করে তিনি নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। রোজ নামচায় একদিন তিনি লিখেছিলেন, “কোন পথে আমি জীবনকে ভাসিয়ে দিলাম, এই তো আমার টেবিলের সামনে রাধা কৃষ্ণের ছবি। এই প্রেম স্বর্গীয়। এমন ভাবেই মাতৃভূমিকে আমাকে ভালোবাসতে হবে। অন্য কোন ভালোবাসা আমার হৃদয়ে স্থান পাবে না। রাধার মতই আমার দেশপ্রেম আমি উজাড় করে ঢেলে দিব। নিজেকে নিঃশেষে আমি দান করে যাব”। সর্বাধিনায়ক মাষ্টারদা সূর্যসেন ১৯৩২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর রাত্রিতে পাহাড়তলী চট্টগ্রাম ইউরোপীয়ান ক্লাবে আক্রমন করা হবে এই নির্দেশ দিলেন। যার নেতৃত্বে থাকবে প্রীতিলতা এবং সহযোগী হিসেবে থাকবে সাতজন সশস্ত্র যোদ্ধা। দায়িত্ব পেয়ে সেটাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে তাঁর মনে এক নতুন শিহরন জাগাল। আত্মদানের জণ্য কঠোর সংকল্প নিলেন এবং নেতাকে প্রনাম করে আশীর্বাদ চাইলেন। সময় স্থির হল রাত দশটা। খাকী পোশাকে প্রীতিলতা কোমরের চামড়ার কটিবদ্ধভরা রিভলবার ও চামড়ার খাপে ভরা গোর্খা ভোজালী, পায়ে মোজা ও বাদামি রং এর ক্যানভাসের রাবার সোলের জুতা। মাথায় দীর্ঘ কেশ রাশিকে সুসংবদ্ধ করে তার উপর বাঁধা হয়েছে সাময়িক কায়দায় পাগড়ী। অন্যান্য বিপ্লবীদের হাতে ইতিপূর্বে অস্ত্রাগারের দখল করা রাইফেল, কোমরে রিভলভার ও ভোজালীর কাঁধে ঝোলাতে বোমা। তারা সবাই রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাবুর্চির সংকেতের টর্চলাইট পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে “চার্জ” এই আদেশ দিয়ে রিভলবারের গুলি ছুড়তে ছুড়তে প্রীতিলতা এগিয়ে গেল গুলি বর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করে। উদ্দাম বিদেশী বল নৃত্যের মধ্যে নেমে এল মৃত্যুর হাহাকার আর ধ্বংসলীলা। ঐ অপারেশনে তিপ্পান্ন জন ইংরেজ নর-নারী হতাহত হন। মিশন শেষে গোপন আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে যাবার সময় একটি গুলি এসে প্রীতিলতার বুকে লাগতেই তার পবিত্র দেহ ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। রক্তস্রোতে সামরিক পোশাক, রক্তে রঞ্জিত সমগ্র দেহ যন্ত্রণায় ছটফট করছে তবুও তার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হয়নি। শক্র পক্ষের হাতে ধরা পগে লাঞ্জনা, নিপীড়ন, অপমান বা দলের গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের জন্য প্রাণঘাতী পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুর হিমশীতল ছায়াতলে চিরতরে চলে গেলেন। রেখে গেলেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। পোষ্টমর্টেম করতে গিয়ে ইংরেজরা জানতে পারেন দেহটি একজন নারীর। এভাবে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন। গ্রীক পুরানের ফিনিক্স পাখি যেমন বার বার আগুনের ভেতর থেকে জন্ম নেয়, ভস্ম হয়ে গেলেও মরে না, ঠিক সেভাবেই তার রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই আরেক তেভাগা (মালিক, শ্রমিক, উৎপাদন খরচ) আন্দোলনের বীর নেত্রী ইলামিত্র বিপ্লবের পতাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে উঠেন ও পড়াশুনা করেন কলকতার বেথুন স্কুল ও কলেজে। ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। খেলাধুলার পাশাপাশি বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, রাজ্য জুনিয়র অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন সহ গান, অভিনয় ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সমান পারদর্শী ছিলেন ইলামিত্র। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৫ সালে জমিদার রামেন্দ্র মিত্রের রাথে তার বিয়ে হয়। সমাজসেবায় তিনি সকলের কাছে হয়ে উঠলেন রাণী মা। সে সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদারে মধ্য স্বত্বভোগী এক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। জোতদার ও জমিদারী প্রথা ক্ষদ্র কৃষকদের শোষনের এক নতুন হাতিয়ার। এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি ভাগের দুই ভাগ ফসল কৃষকের এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর মিত্র পরিবারের জমিদারী অঞ্চল, রামচন্দ্রপুর হাট রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। তিনি এবং তার স্বামী জমিদার হয়ে ও মেহনতি মানুষের পক্ষে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশভাগের আগে নাচোল ছিল মালদহ জেলার অন্তর্ভুক্ত। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে বামপন্থী এই বীর নেত্রীকে গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি যে রাণী মা তিনি কি আন্দোলনে বিরত থাকতে পারেন? সে আন্দেলনে অনেক সাঁওতাল ও কৃষক নিহত হয় পুলিশের গুলিতে। গ্রেফতার চলে নির্বিচারে। ১৯৫০ সালের ৭ই জানুয়ারী ইলামিত্র রোহনপুরে গ্রেফতার হন এবং পরদিন তাঁকে নাচোলে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তাকে ব্যাপক মারধর করেন এবং একটি সেলের মধ্যে নিয়ে যান। সেখানে হত্যাকান্ড সম্পর্কে দোষ স্বীকার না করায় সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়। সন্ধ্যায় পুলিশেরা বন্দুকের বাট দিয়ে মারপিট করে। ফলে তার মাথা ফেটে যায় এবং নাক দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। রাতে পুলিশের এক কর্মকর্তার বাসায় নিয়ে গিয়ে যোনীপথে গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দেয়। ১৬ই জানুয়ারী পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন কায়দায় অকথ্য, অমানবিক নির্যাতন  চালায়। রাতে তাঁকে ধর্ষন করে এবং বলতে থাকে পাকিস্তানী ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এরপরেও তিনি পুলিশের কাছে মাথা নত করেননি। নবাবগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসার পর ২১শে জানুয়ারী তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। একটানা প্রায় আড়াই বছর জেল হাজত খাটার পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর ইলামিত্র কলকাতায় চলে যান উন্নত চিকিৎসার জন্য। এরপর তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা আর এদেশে তাঁকে আর আসতে দেননি। তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে তিনবার বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর এই বীর নারী ৭৬ বছর বয়সে কলকাতায় ইহলোক ত্যাগ করেন। কথায় আছে-‘সাফল্য কারো জন্ম দেয়নি বরং মানুষই সাফল্যের জন্মদাতা।’ বীরকন্যা প্রীতিলতা ও বীরনেত্রী ইলামিত্র সাফল্যের জন্ম দিয়েছেন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্রকাননে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত  হয়েছিল তা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এবং প্রায় ২ লক্ষ মা বোনের ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের বয়স ছিল পনের থেকে পঁচিশ, টগবগে যৌবন, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল সম্ভ্রম আর সতীত্ব। সেই যৌবনই ছিল তাঁদের জীবনের সবচেচে বড় শক্র। খান সেনারা বা তার সহযোগীরা জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘদিন তাদের ক্যাম্পে বা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল রক্ষীতা বা গনীকা হিসেবে। দিন এবং রাত সর্বদা চলত পাশবিক নির্যাতন। এই কান্না, আর্তনাদ বা চিৎকার, লজ্জা রক্ষার আবেদন, আকুতি, মিনতি শয়তানদের মন গলাতে পারেনি। ফলে যা সর্বনাশ হওয়ার তাই হয়েছিল। যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন আকাশ পেলাম, আজ সেই আকাশ থেকেই দিনে প্রচন্ড রোদ আর বর্ষার দিনের বৃষ্টি তাদের মাথা গোঁজানো ঠাঁইয়ের নিত্য সঙ্গী। স্বাধীন জমিন পেলেও তারা এই জমিনে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না। ক্ষুধার জ্বালা, সম্ভ্রম হারানোর বেদনা, সামাজিক বদনাম আর নিষ্ঠুর আকাশও যেন এক সময়ের যৌবনের মত শত্র“। সকল দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রনা, অপমান, বদনাম একাকার হয়ে মিশে আছে তাদের দুর্বিসহ জীবনে। সমাজে, সংসারে, বাবা এবং মায়ের বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তাঁদের। বিয়ে হলেও সংসার হয়নি। আর সংসার হলেও তার রক্ষা হয়নি। অনেকে পেটের বাচ্চা নষ্ট করেছিল। কার ও সন্তান প্রসব হলে লোক লজ্জার ভয়ে গোপনে তা ফেলে দিয়েছিল। আর অনেকে অন্ধকার ভবিষ্যত দেখে আত্মহত্যা করেছিল। অনেকেই হয়তো মনে করেছিল আত্মহত্যার মত মহাপাপের পথ বেছে না নিয়ে তারা একাই চলতে পারবে। হয়তো তাদের দুঃখ সে সময়ের বাস্তবতা সমাজ মেনে না নিলেও পরিবার-পরিজন ঘৃণাভারে হলেও মেনে নিবে। হয়তো সন্তানেরা তাদের মায়েদের ব্যথা উপলব্ধি করে এক সময় মধুর ডাক মা বলে ডাকবে। শুধু আমাদের দেশেই নয় সারাবিশ্বে যুদ্ধের সময় নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীদের কেই একতরফা দোষ দেওয়া হয়। নারী হয়ে জন্ম নেওয়া এবং বীরাঙ্গনা হওয়ারই তাঁদের একমাত্র অপরাধ। এর মধ্যে কোন মা বেদনায় কুঁকড়ে ঊঠা পেটের অবৈধ সন্তান নিয়ে রাস্তার পাশে, রেলের বস্তিতে, লোকালয় থেকে দূরে, নিজ এলাকা থেকে অন্যত্র গিয়ে অথবা সরকারি খাস জমিতে গিয়ে একটু আশ্রয় নিয়েছিল। শীতের দিনে প্রচন্ড ঠান্ডায় বুকের উষ্ণতা দিয়ে, মায়া-মমতার আর্দ্রতা দিয়ে, অজানা শঙ্কা দিয়ে সন্তান জম্ম দিয়েছেন। পরবর্তীতে সেই সন্তান নিজের জন্ম পরিচয় বা পিতৃপরিচয় জানতে না পেরে বা বুঝাতে পেরে চির দুখিনাী বা জনমদুখিনী মা কে ফেলে দুরে পালিয়ে গেছে। তবে চলে যাবার আগে দিয়ে যায়নি দশ মাস দশ দিনের পেটে রাখার ভাড়া। মাতৃজঠরে বহনের খরচ, মাতৃক্রোড়ে বা বুকের সাথে ঝাপটে ধরা ভালোবাসার দাম। নিজে অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে, অর্ধমৃত বা প্রায় মৃত শরীরে বা মুখে নিজে খাবার না দিয়ে তাদের খাওয়ানোর মূল্য,দিনে ও রাতে একাকী সেবা করার পরিশ্রমের ফল আর জন্মের সময়ের পৃথিবীর চেয়ে মরণযন্ত্রনা প্রসর ব্যথার উপহার। যদিও তাদের পিতৃপরিচয়ের জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালী স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীরাঙ্গনাদের  উদ্দ্যেশে বলেছিলেন, “সন্তানদের বাবার নামের জায়গায় তাঁর নাম এবং ঠিকানা ৩২ নম্বর ধানমন্ডি লিখে দিও।” দীর্ঘ ৪৪ বছরে রোগে, শোকে, অন্তর্জ্বালায় জর্জরিত জীবন প্রদীপ কারো নিভে গেছে, কারো বাকি আছে। তাদের চোখ আছে, অশ্র“ নেই। কলাগাছের মত শুকনা শরীর  আছে, শক্তি নেই। কিচমিচের মত গাল আছে, সৌন্দর্য নেই। মুখে ঠোঁট আছে, বলার ভাষা নেই। নেই তাঁদের সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। দুঃখিত ভুল করলাম। বর্তমান সরকার প্রধান মাননীয় প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ২৯শে  জানুয়ারী ২০১৫ মহান জাতীয় সংসদে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব পাশ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। এর মধ্য দিয়ে নির্যাতিত বীরাঙ্গনাদের প্রথমবারের মত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল। যা নারী জাতির জন্য বা মানব জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। নির্যাতিতকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ায় তিনিও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হচ্ছেন। অন্যকে সম্মান দিলে নিজেও সম্মানিত হওয়া যায়। এটাই তার জ্বলন্ত প্রমান। পরিশেষে যুদ্ধ কিংবা শান্ত পরিবেশে জোরপূবক অবৈধ দৈহিক মিলনের ফলে যে নিষ্পাপ সন্তান জন্ম হয় তাকে আমরা “জারজ” সন্তান বলি। যদিও “জারজ” শব্দটি বীরাঙ্গনাদের ক্ষেত্রে বলা ঠিক নয়, কাম্যও নয়। যারা এই ঘৃণিত কাজ করে তারা নিজেকে ভন্ড বা শয়তান মনে না করে চরিত্রবান মনে করে। তাদের অজ্ঞতা বা মূর্খতার জন্যই বিপ্লবী কবির কালজয়ী উক্তি লিখে বীরাঙ্গনাদের শ্রদ্ধা এবং বর্তমান সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করছি “ শুন ধর্মের চাঁই- জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই। অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।”



লেখক ঃ সহকারী প্রধান শিক্ষক। ফরক্কাবাদ এন.আই স্কুল এন্ড কলেজ, বিরল, দিনাজপুর।