চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই রাজাকারের আমৃত্যু কারাদন্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলামও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
১৩৩ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা তিনটি অভিযোগের মধ্যে প্রথমটিতে দুই আসামিকে সর্বসম্মতভাবে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন তিন বিচারক। 
দ্বিতীয় অভিযোগে মাহিদুর রহমান ও আফসারকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের জেল। এ সাজার আদেশ হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।
আর তৃতীয় অভিযোগে এর আগে দালাল আইনে তারা দণ্ডিত হওয়ায় ওই অভিযোগটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
মাহিদুর ও আফসার একাত্তরে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে তারা শিবগঞ্জ এলাকায় যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।
ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত আসা ১৮টি যুদ্ধাপরাধের মামলায় ২০ আসামির মধ্যে ১৩ জনের ফাঁসির রায় এসেছে। তাদের মধ্যে দুইজনের মৃত্যুদণ্ড সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর কার্যকর করা হয়েছে।

একাত্তরের রাজাকার মাহিদুর-আফসার
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের দাদনচক গ্রামের সুবেদার আলী বিশ্বাসের ছেলে মো. মাহিদুর রহমানের বয়স বর্তমানে ৮৪ বছর। ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, মাহিদুর লেখাপড়া করেছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত।   
মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক ছেলে ও চার মেয়ের বাবা মাহিদুর একাত্তরে ছিলেন কৃষিজীবী। স্থানীয় মুসলিম লীগের রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর মাহিদুর সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পেই থাকতেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আশপাশের এলাকায় হত্যা, লুটপাট, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, আফসার হোসেন ওরফে চুটুর বয়স বর্তমানে ৬৫ বছর। তিনি শিবগঞ্জের বিনোদপুর ইউনিয়নের সাতরশিয়া গ্রামের কুতুব উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে।
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা আফসার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। মাহিদুরের মতো একাত্তরে তিনিও ছিলেন কৃষিজীবী এবং মুসলিম লীগের কর্মী।
আফসারও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং ওই এলাকায় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালান।

মামলার পূর্বাপর
মুক্তিযুদ্ধের সময় শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর স্কুল মাঠ ও আশেপাশের এলাকায় গণহত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুসহ ১২ জনকে আসামি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে একটি মামলা হয়।
মামলাটি করেন গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারের সদস্য শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের পারচৌকা গ্রামের বদিউর রহমান বুদ্ধু। পরে তা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
প্রসিকিউশনের তদন্ত দল এ দুই রাজাকার সদস্যের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে গতবছর ১১ ফেব্রুয়ারি। তদন্ত শেষে ৭ খণ্ডে ৯৫৬ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জের দুর্লভপুর ইউনিয়ন থেকে মাহিদুর এবং বিনোদপুর থেকে আফসারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ওইবছর ১৬ নভেম্বর মাহিদুর ও আফসারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। ২৪ নভেম্বর তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেয়।
অভিযোগ গঠনের পর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গতবছর ১২ জানুয়ারি শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেডএম আলতাফুর রহমানসহ প্রসিকিউশনের মোট ১০ জন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে দুই আসামির পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিলেন না।
সাক্ষ্য-জেরা শেষে দুই পক্ষের আইনজীবীরা আদালতের সামনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে।
যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল গত ২২ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে।
অষ্টাদশ রায়
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।
৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।
ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।  গতবছর ৩ নভেম্বর আপিলের রায়েও তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১১ এপ্রিল।      
মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে ২০১৩ সালের ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গতবছর ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু।
২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ওই বছর ১ অক্টোবর  সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তারা দুজনই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গতবছর ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।
দশম রায় আসে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর। জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকেও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা, যিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে ‘স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে’ ইসলামের অপব্যবহার করেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়।  তিনিও এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।
একাদশ রায়ে গতবছর ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। জামায়াতে ইসলামীর এই শুরা সদস্যকে দলটির প্রধান অর্থ যোগানদাতা বলা হয়ে থাকে।
এরপর ১৩ নভেম্বর ফরিদপুরের রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।
২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকেও আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়।
গতবছর ২৩ ডিসেম্বর এরশাদ আমলের প্রতিমন্ত্রী ও একাত্তরে হবিগঞ্জের মুসলিম লীগ নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে আদালত সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয়।
এরপর ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির আদেশ আসে।
চলতি বছরের প্রথম রায়ে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানকেও একই সাজা দেওয়া হয়।
আর ট্রাইব্যুনালের সপ্তদশ রায়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান পলাতক আবদুল জব্বারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ বিডি নিউজ থেকে/ ২০-০৫-১৫