আমাদের সন্তানদের সর্বনাশ আমরাই করছি------- গোলাম কবির

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিক্ষাবৎসল ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের গত ১৩ মার্চ কালের কণ্ঠে সম্পাদকীয় পাতায় 'এ দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সর্বনাশ করল কে?' শিরোনামের সময়োচিত লেখাটি পড়লাম। আমাদের সন্তানদের সর্বনাশ যে আমরাই করে চলেছি, লেখক এ সত্য উচ্চারণ করতে দ্বিধা করেননি। লেখকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমারও কিছু ভাবনা উপস্থাপন করতে চাই আজকের সর্বনাশের সূচনা কেমন করে হলো এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল যুক্তরাষ্ট্র নামক স্বর্গ থেকে আপন দুর্ভাগা জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন দেশের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষার রসে সঞ্জীবিত করতে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন শিক্ষণ ও পরীক্ষণ পদ্ধতি কবে চালু হবে, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। শেষ পর্যন্ত শিক্ষা ও পরীক্ষাক্ষেত্রে চালু হলো সৃজনশীল পদ্ধতি। অথচ ফলাফল 'সকলি গরল ভেল'। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ক্ষুব্ধ। লেখাটি তারই বহিঃপ্রকাশ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সর্বনাশের কুশীলব কে বা কারা সে প্রশ্ন রেখেছেন তিনি। আংশিক উত্তরও আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে কিছু ধারণা আমরা সংযোজন করতে চাই।
ষাটের দশক থেকে আমি শিক্ষকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এমনকি মাদ্রাসায়ও শিক্ষকতা করার পর স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকে সরকারি কলেজে চাকরি করে প্রায় দুই দশক আগে অবসরে গেছি। বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীকালের শিক্ষা ও শিক্ষকতার সঙ্গে তাই কিছুটা পরিচয় হয়েছে আমার।
একদা গ্রামগঞ্জে কিংবা শহর-বন্দরে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শিক্ষকতায় আসতেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। আমরা তাঁদের পূর্ণ সাহচর্য পেয়ে ধন্য হয়েছি। আজ তাঁদের তুলনায় নিজেকে দীন মনে হয়। এটা বোধ করি সত্যের অপলাপ হবে না যে এখন আমরা যত এগোচ্ছি ততই প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষাঙ্গন থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে প্রথমে আমার মনে হয়েছে, কিছু স্বার্থান্ধ স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতার অপব্যবহার। পাকিস্তানের শেষের দিকে আইয়ুব শাহিকে পাকাপোক্ত করার জন্য তাঁর এ দেশীয় প্রতিনিধি মোনায়েম খান জেলা পর্যায়ের কলেজ আর মহকুমা পর্যায়ের বিদ্যালয় (একটি বালক এবং একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) জাতীয়করণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একই মানসিকতার শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে মহকুমা, এমনকি থানা পর্যায়ের অনেক নাম-গোত্রহীন কলেজ সরকারীকরণ হয়। সস্তা জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের সময় জাতীয়কৃতদের প্রকৃত শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা যাচাই করা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। কে না জানে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষক ভালো কোনো চাকরি না পেয়ে অনুদানের নামে নগদ নারায়ণ দিয়ে শিক্ষকতায় এসেছেন। ইতিহাস বলছে, সাতচল্লিশে দেশভাগের পর প্রচুর মেধাবী শিক্ষক দেশান্তরিত হন। ওই সব শূন্য স্থানে যাঁরা নিয়োজিত হন তাঁরা অনেকটা মানসম্পন্ন হলেও পরে এর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকেনি। কারণ যাঁরা দায়ে পড়ে শিক্ষক হতে বাধ্য হন তাঁদের মধ্যে শিক্ষকসুলভ ত্যাগ ও সেবার মানসিকতা তৈরি হয়নি। তাঁরা শ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল জাগাতে এগিয়ে আসেননি। গুটিকয়েক ব্যক্তি অর্থপ্রাপ্তির আশায় নোট, সমাধান, ডাইজেস্ট ইত্যাদি লিখে নিজের ও প্রকাশকের পকেট ভারী করেন। দুর্ভাগা শিক্ষার্থী তা-ই মুখস্থ করে পরীক্ষা নামের বৈতরণী পার হয়। দুঃখের বিষয়, অনেক শিক্ষক ওই সমাধানজাতীয় বই পড়ে শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেষ্টা করেন। কেবল তা-ই নয়, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময় ওই সব সমাধান থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেন। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন তাঁর লেখায়।
প্রথম শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোতে কারা কর্ণধার নিয়োজিত হচ্ছেন, সে বিষয়টি ভেবে দেখার অবকাশ আছে। 'কুন ফাইয়াকুন' হও, অতঃপর হয়ে যাওয়ার বদৌলতে যাঁরা রাতারাতি সরকারি কর্মকর্তা বনে গেলেন এবং লেজুড়বৃত্তি করে বড় বড় পদে আসীন হলেন, তাঁদের পক্ষে প্রকৃত শিক্ষক যাচাই-বাছাই করা সহজ নয়। সরকারকে এ ব্যাপারে কঠিন হতে হবে। কঠিনেরে ভালো না বাসলে আমাদের ছেলেমেয়েরা সর্বনাশের হাত থেকে রেহাই পাবে না।
প্রশ্নপত্র প্রণয়নের এই গোঁজামিলের বিষয়টি নতুন করে গজায়নি। ওই যে বলছিলাম, আদেশের বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেদিন থেকে আত্তীকৃত হলেন সেদিনই নিজেদের কেউকেটা ভাবতে শুরু করলেন এবং মূল জাতীয়কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নানা কৌশলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে ভিড় জমালেন। বলতে গেলে কর্তৃত্ব অনেকটা তাঁদের হাতেই চলে গেল। এখানে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কী শিক্ষা পাবে এবং প্রশ্নপত্রই বা প্রণীত হবে কেমন!
কুড়ি বছরেরও আগে একটি শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নপত্র সমীক্ষণের জন্য আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। যাঁরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন তাঁরা জানেন, কোন প্রশ্নটি কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে, তা প্রশ্নপত্রের এক পাশে পেনসিল দিয়ে উল্লেখ করতে হয় সমীক্ষণের সময় যাচাইয়ের সুবিধার জন্য। জনৈক প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী উল্লেখ করেছেন, তবে কোন প্রশ্নটি কোন শিক্ষা বোর্ডে কত সালের পরীক্ষায় ছিল, সেটি তুলে দিয়েছেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে জানানো হলো। তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন না। চেয়ারম্যান মহোদয়কে জানানো হলে তিনি সমীক্ষকদের সিদ্ধান্ত নিতে বললেন। আমরা সম্মিলিতভাবে প্রশ্নপত্রটি ঢেলে সাজালাম এবং সুপারিশ করলাম, এ ধরনের শিক্ষককে যেন এত বড় গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্বের কাজে সংশ্লিষ্ট করা না হয়। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তা হয়তো ভেবে দেখার সুযোগ পায়নি। তারা নজর দিলে বর্তমানের সর্বনাশা ঘটনা ঘটত না।
উচ্চশিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হওয়া উন্নত জাতির লক্ষণ। তাই বলে গোটা বিশ্বকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রভুত্বদানকারী ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব কম করে দেখলে চলবে কেন? মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা যখন থেকে চালু হয়েছে তখন থেকে একই প্রশ্নপত্রে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভার্সনই থাকত। কৃত্রিম বাঙালিয়ানা দেখানোর জন্য কিছুদিন কেবল বাংলা ভাষাতেই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হলো। ঘোর কেটে যাওয়ার পর নতুন করে ইংলিশ ভার্সন পড়ানো শুরু হয়েছে (বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তো বাংলা মাধ্যমে পড়ছে)। ফলে প্রয়োজন দেখা দিয়েছে ইংরেজি ভাষায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর লেখায় ইংলিশ ভার্সন প্রশ্নপত্রের যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা থেকে বোঝা যায় আমাদের শিক্ষকদের পাণ্ডিত্য কোন অতলে গিয়ে ঠেকেছে (অবশ্য সব শিক্ষক নয়)। আগের মতো একই প্রশ্নপত্রে ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষা ব্যবহার করা হলে পৃথক প্রশ্নপত্রের প্রয়োজন পড়ত না এবং হাতুড়ে ইংরেজি জানা শিক্ষক দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করিয়ে জাতিকে লজ্জায় ফেলা হতো না।
আমরা জানি কলাম লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সুসাহিত্যিক, সংস্কৃতিবান, বিজ্ঞানমনস্ক এবং আশাবাদী মানুষ। আমরাও হাল ছেড়ে দিতে চাই না। সরকার যদি শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষাসংক্রান্ত দপ্তরগুলোতে যথাযথ ব্যক্তিদের বাছাই করে নিয়োগ দিত এবং তারা যদি প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তিকে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ভার দিত, তবে জাতি বোধ করি রক্ষা পেত।
পরিশেষে সকাতরে আবেদন রাখতে চাই, জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ ও এমপিওভুক্তি স্থগিত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে সনদধারী বেকারদের পুনর্বাসনের জন্য স্কুল-কলেজ নয়, বেকার ভাতার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এতে সরকারি কোষাগার হয়তো কিছুটা শূন্য হবে; কিন্তু জাতি মেধাশূন্যের সর্বনাশ থেকে মুক্তি পাবে।
আমার বক্তব্যে কেউ কেউ ক্ষুণ্ন হতে পারেন, তাঁদের উদ্দেশে সবিনয়ে বলতে চাই, পাকিস্তান আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা। তখন শিক্ষকরা রাজনীতি সচেতন ছিলেন জাতীয় কল্যাণের জন্য। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর জাতীয়করণ করা হয় শিক্ষকদের দলভুক্ত করার জন্য। এতে হয়তো দলীয় সমর্থক কিছুটা বেড়েছে। উপকার হয়েছে দলের, জাতির নয়। আজকের জাতীয়করণ বা এমপিওভুক্তি অনেকটা করুণা প্রদর্শন। প্রকৃত শিক্ষক করুণার পাত্র হবেন কেন? আমরা যেদিন করুণাকে বর্জন করতে শিখব সেদিন থেকে আমাদের সন্তানরা আর বঞ্চিত হবে না।

লেখক : গোলাম কবির, পুরো নাম গোলাম কবির মুহাঃ নুরুল হুদা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সন্তান, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক