দিবরদীঘির স্বচ্ছ জলরাশি আর দিব্যকের জয়স্তম্ভ -----------------ফয়সাল মাহমুদ

২১ ফেব্র“য়ারির কাক ভোর। ফাল্গুনের অন্যান্য ভোরের চেয়ে একটু আলাদা। শীতের খুব একটা তীব্রতা ছিলনা। তবে চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। এসময় সাধারণত এত কুয়াশা পড়েনা। কুয়াশার কারণে কয়েক মিটার দুরের কিছুও দেখা যাচ্ছেনা। এমন একটি দিনেই আমাদের গন্তব্যহীন যাত্রা। দিনটিকে বেছে নেওয়ার একটি কারণ আছে। স্থানীয় পত্রিকায় যোগদানের পর সুইট ভাই (ইমতিয়ার ফেরদৌস সুইট) ছুটি পাননা। তাই ঘোরাঘুরির সুযোগও সীমিত হয়ে গেছে তাঁর। একুশে ফেব্র“য়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে পত্রিকার ছুটি। এই ছুটিকে ভ্রমনের কাজে লাগানো কথা প্রথম ভেবেছিলেন তিনিই। দূরপথে মোটর সাইকেল ভ্রমণ হবে। রুট নির্ধারণ করেছি আমরা। কিন্তু কোথায় গিয়ে থামব তা নির্দিষ্ট ছিলনা। আমি, সুইট ভাই ছাড়াও দলে রয়েছেন রাসেল আহমেদ, সারোয়ার জাহান লিটন, শরিফুল ইসলাম, মামুন-অর-রশীদ। লিটন আর মামুন আমাদের দলে নতুন। একসঙ্গে সকালের নাস্তা শেষে যথারীতি শুরু হলো আমাদের যাত্রা। তিনটি মোটর সাইকেলে রওনা হলাম নওগাঁর উদ্দেশ্যে। বরেন্দ্র অঞ্চলের সরু সড়ক দিয়ে এগিয়ে চলেছি। সড়কের দুই ধারে বিস্তৃত কৃষি জমি। সিঁড়ির মতোই থরে থরে সাজানো। জমিতে চাষাবাদে ব্যস্ত কৃষক। ফাঁকা মাঠের মাঝে মাঝেই এক পায়ে দাড়িয়ে তালগাছ। যদিও এখন তাল গাছের সংখ্যা কমে গেছে। বড় যানবাহন একেবারেই নেই সড়কে। ছোট যানবাহন চলছে। অবরোধের কারণে এই অবস্থা। প্রায় সমগতিতে পরপর ছুটছে তিনটি মোটর সাইকেল। প্রথমবারের মতো আমাদের গতিরোধ হলো আমনূরায়। একটি রেলক্রসিং দিয়ে পার হচ্ছে প্রভাত ফেরি। খালি পায়ে, হাতে ফুল আর কণ্ঠে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে শহীদ মিনারের দিকে। ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবে। এর আগে এবং পরে সড়কের ধার দিয়ে আমরা অনেক কিশোর, কিশোরীকে ফুল হাতে যেতে দেখেছি শহীদ মিনারের দিকে। অজপাড়া গাঁয়ে ভাষার প্রতি, ভাষা শহীদের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দেখে মন ভরে যায়। অজান্তেই গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি, মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলাভাষা। ভাষাকে এতটা ভালবাসা যায় বলেই সালাম, রফিক, বরকত জাব্বাররা নিজের জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। ভাষাকে এতটাই ভালবাসা যায় বলেই আজ একুশে ফেব্র“য়ারি বিশ্ববাসীর, আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
আমার ছুটে চলেছি। পার্বতীপুর-আড্ডা বাজারে প্রথম চা বিরতি শেষে আবারো ছুটে চলা। প্রথম বিপত্তি বাধে পোরশার প্রবেশ পথে। একটি মোটর সাইকলের  পেছনের চাকা দুটি কাঁটায় ফুটো হয়ে গেছে। এটাকে সৌভাগ্য বলে মেনে নিলাম। কারণ স্থানীয় একটি বাজারের মাত্র আধা কিলোমিটারের মধ্যেই ঘটেছে এই ঘটনা। তার আগে অন্তত পাঁচ/ছয় কিলোমিটার ফাঁকা সড়ক পার হয়ে এসেছি। ওই পথে এমন ঘটলে বিপদে পড়ে যেতাম। লিক সারানোর পর আবারো যাত্রা শুরু। সরাইগাছী মোড় হয়ে সাপাহার বাজার পার হওয়ার পর আমরা পতœীতলা-নজিপুর সড়কে। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর হাতের বাঁয়ে একটি সরু সড়ক ধরে যাচ্ছি দিবর দীঘির দিকে। দিবরদীঘি একটি ঐতিহাসিক স্থান। পতœীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নের দিবর গ্রামে অবস্থিত এই দীঘি। দেবদারু গাছের নিবিড় ছায়ায় ইট বিছানো পথ দিয়ে আমরা গেলাম দীঘির ধারে। দীঘির নয়নাভিরাম স্বচ্ছ জলরাশি মুহূর্তেই মুগ্ধ করে আমাদের। দীঘির মধ্যস্থলে মাথা উচু করে আছে একটি স্তম্ভ। ইতিহাস বিশ্লেষণকারীদের বেশিরভাগরেই দাবি, এটি দিব্যকের জয়স্তম্ভ।
পাল আমলে খননকৃত প্রায় ৬০ বিঘা দীঘির মাঝখানে স্থাপিত এই স্তম্ভটি অখন্ড গ্রানাইড পাথরের। আশ্চর্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে স্তম্ভটি। কতোটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে স্থাপন করলে এতোদিন পরেও বিন্দুমাত্র না হেলে একই অবস্থানে ঠাঁই থাকতে পারে একটি স্তম্ভ- এটা ভেবে অনেকেই অবাক হন। ইন্টারনেটে এই সংক্রান্ত তথ্য খুঁজতে গিয়ে অনেকের অবাক হওয়া মন্তব্য দেখতে পেয়েছি। উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ওয়েব সাইট ও সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী স্তম্ভটির উচ্চতা ৩১ ফুট। এর মধ্যে পানির উপরিভাগে ১০ ফুট, পানির নিচে ১০ ফুট ও মাটির নিচে ১১ ফুট গ্রথীত আছে। স্তম্ভটি গ্রানাইড পাথরের। গ্রানাইড পাথর এই উপ-মহাদেশে কেবলমাত্র মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে পাওয়া যায়। এই জয়স্তম্ভ আর দীঘিকে ঘিরে দর্শনার্থীদের আনাগোনা লেগেই থাকে। যদিও এখন হরতাল-অবরোধের কারণে তা অনেক কমে গেছে। তিন/চার তরুণী আর ছয়/সাতজন তরুণ ছাড়া দর্শনার্থী ছিলনা। সেখানে যোগ হলাম আমরা ছয়জন। স্থানীয়রা জানালেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এই সময়ে প্রতিদিন দুই/তিনটি পিকনিক বা বনভোজন হয় দীঘির পাড়ে। কয়েক শ’ লোকজনের আনাগোনা থাকে। দীঘি তীরে একটি নৌকা বাধা আছে। স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে গেলে, যেতে হবে ওই নৌকাতেই। জনপ্রতি ভাড়া গুনতে হবে দশ টাকা করে। ছয়জন মিলে গেলাম সেখানে। স্তম্ভের চূড়ায় বসে আসে দুটি পাখি। দূর থেকে আমরা ভেবেছিলাম পাখি নয়, পাথরের প্রতিকৃতি। কিন্তু আমাদের নৌকা কিছুদূর যাওয়ার পরই উড়ে গেল একটি পাখি। বসে থাকা আরেকটি পাখির ছবি তুলতে চেয়েছিলেন লিটন ভাই। ক্যামেরা অন করতে গিয়ে সেটাও উড়ে গেল। ‘ইস’ বলে মিস হওয়ার কথা জানান দিলেন তিনি। এরইমধ্যে আমাদের নৌকা পৌঁছে গেছে স্তম্ভের কাছে। আগে বিশ্বাস না করলেও কাছে গিয়ে অবিশ্বাসের কোন সুযোগই নেই। সত্যিই এটি একটি অখন্ড পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। এই স্তম্ভের চারটি কোণ রয়েছে। এই বিরাট স্তম্ভের উপরিভাগে পরপর তিনটি রেখা রয়েছে যা স্তম্ভটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। স্তম্ভটির শীর্ষে রয়েছে নান্দনিক কারুকার্য। নৌকার উপরেই দাঁড়িয়ে স্তম্ভকে ব্যাকগ্রাইন্ডে রেখে ছবি তুললাম। দলীয় ছবি তোলার পর কেউ কেউ একক ছবিও তুলে নিলেন সুযোগ বুঝে।
পাথরটির ইতিহাস নিয়ে নানা মত রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় মহিপালের আমলে ১০৭৫ সালে বাংলার কৈবর্ত্য সম্প্রদায়ের প্রভাব বেড়ে যায়। মহিপালের রাজসভায় এই কৈবর্ত্যরা বিভিন্ন জ্যেষ্ঠ পদে অধিষ্ঠিত হন। দ্বিতীয় মহিপাল ছিলেন দুর্বল ও চরিত্রহীন শাসক। তাঁর অযোগ্যতার কারণেই সে সময় বাংলায় অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। কিছু সেনাপতি ও বিপথগামী লোক এই অসন্তোষের এ সুযোগ নিয়ে দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করের। দিব্যক সর্বসম্মতিক্রমে বরেন্দ্রভূমির অধিপতি নির্বাচিত হন। দিব্যকের শাসনামল ছিল ১০৭৫ থেকে ১১০০ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় মহিপালের সময় তিনজন রাজা বাংলায় শাসন করেন। এরা হলেন দিব্যক, রুদ্রক ও ভীম। বৃটিশ ভারতীয় বিশিষ্ট ইতিহাস লেখক বুকারন হ্যামিলটন। পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে ঐতিহাসিক স্থানগুলোর উপর জরিপ করে একটি তালিকা প্রণয়নের জন্য এই অঞ্চলে বুকরান আসেন ১৭৮৯ সালে। ওই সময় তিনি দীঘির পার্শ্বে এসে উপস্থিত হয়ে জরিপ করেন। বুকারন হ্যামিলটন ঐ দীঘিটিকে কৈবর্ত্যদের বলে উল্লে¬খ করেন। তার মতে জনৈক ধীবর রাজা এটি তৈরি করেন। তবে বৃটিশ প্রতœতত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিং হামের মতে, একাংশ শতাব্দির কৈর্বত্য রাজা দিব্যকের ভ্রাতা রুদ্রকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কীর্তি এটি। এ স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতবিরোধ থাকলেও আজ অবধি দিব্যকের কীর্তি বলে অত্রাঞ্চলে প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। ধারণা করা হয, এই শাসনামলে পাল বংশকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে দীঘির মাঝখানে জয়স্তম্ভ স্থাপন করা হয়।
দিবর দীঘিতে গিয়ে পরিচয় হলো পতœীতলা উপজেলার এক ঠিকাদারের সঙ্গে। আমাদের গন্তব্যহীন ভ্রমণের কথা শুনে তিনিও রোমাঞ্চিত। আমাদের একটা পথের সন্ধান দিলেন, যেই পথ দিয়ে যাওয়া যাবে শালবন। কয়েক হাজার একরের শালবন। যেটাও এখন নওগাঁ জেলার একটি দর্শনীয় স্থান। ওই ঠিকাদারের দেখানো পথে আমার এগিয়ে চলেছি। আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে কিছু মেঠোপথ পেরিয়ে আমরা পৌছলাম শালবনে। ঘন শালবনে ঝরা পাতা আর এলোমেলো বাতাস আমাদের জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে এখন বসন্তকাল। কিন্তু যে শালবনের জন্য এতোটা পথ মাড়িয়েছি, এটা সেই শালবন নয়। এটা যখন জানতে পারলাম, তখন একে অপরের দিকে তাকিয়ে পথভুলের জন্য মৃদু হাসলাম। আমরা আসলে যেতে চাই আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান। ভুল পথের ভুল শালবন থেকে বের হয়ে এবার যেতে হবে সঠিক শালবনে। হেয়ারিং আর কাঁচা রাস্তা পার হয়ে আমার সড়কে উঠলাম। এই সড়ক বেয়েই পৌছালাম ধামইরহাট উপজেলা সদরে। সূর্য ততোক্ষণে মাথার উপর চড়ে বসেছে। সেখানে দুপুরের খাবারের জন্য গেলাম একটি রেষ্টুরেন্টে। স্থানীয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন রেষ্টেুরেন্ট এটি। আমাদের ধূলোধসরিত চেহরা দেখে সকলেই উৎসুক। কয়েকজন জানতে চাইলেন, কোথা থেকে আসছি আর কোথায় যাব। জনে জনেই খুলে বললাম সবকিছু। কথা শুনে হোটেলের ম্যানেজারের চোখ কপালে উঠলো। অবাক কণ্ঠে বললেন, মোটর সাইকেলে চাঁপাই থেকে আসছেন। আমাদের সাবলীল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ানো দেখে আরো অবাক হলেন।