টানা অবরোধের ডাক অবরুদ্ধ খালেদার

পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, যিনি গত দুদিন ধরে নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন।

সোমবার বিকালে গুলশানে নিজের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলেও পুলিশ বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখায় ফটকের ভেতরে দাঁড়িয়ে তিনি অবরোধের এই ঘোষণা দেন।

খালেদা বলেন, “আজ আমাদের কালো পতাকা কর্মসূচি ছিল। সমাবেশ করতে দেওয়া হয় নাই। পরবর্তী কর্মসূচি না দেওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে। ...তারপর যখন আবার পরিবেশ পরিস্থিতি আসবে তখন আমরা সমাবেশ করব।”

সরকারের প্রতি তিনি প্রশ্ন করেন, “আমরা চেয়েছিলাম একটা সমাবেশ করব। সরকার আমাদের সমাবেশ করতে দিল না। সমাবেশ করতে না দেওয়ার কারণ কী?”

তিনি বলেন, “টেলিভিশনে দেখছি সরকার বলছে, ‘তাকে আমরা বন্দি করি নাই’।তাদের কথা হলো নিরাপত্তা...। কিসের জন্য, কী নিরাপত্তা তারা... এতোদিন তো কোনো নিরাপত্তা দেয়নি। হঠাৎ করে আমাদের কর্মসূচি আসলে নিরাপত্তার কথা তাদের মাথায় আসে; আর তখন সব বন্ধ করে রেখে দেয়। এটা কোন ধরনের নিরাপত্তা?”

বিএনপি প্রধান খালেদা টানা অবরোধের ঘোষণা দিলেও আগামী শুক্রবার থেকে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হচ্ছে তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমা। সারা দেশের মতো বিদেশ থেকেও মুসল্লিরা সেখানে যোগ দিতে আসবেন।

ইজতেমার কারণে অবরোধের কর্মসূচিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি-না সে বিষয়ে কিছু বলেননি বিএনপি নেত্রী।

সোমবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে দোতলায় নিজের কক্ষ থেকে নেমে নিচে রাখা সাদা রঙের নিশান পেট্রোল গাড়ির সামনের আসনে বসেন খালেদা জিয়া। কিন্তু গাড়িটি তালাবন্ধ ফটকের সামনে এসে আটকে যায়।



এরপর তার উপদেষ্টা সাবেক পুলিশ মহাপরির্দশক আবদুল কাইয়ুম গেইটের ফাঁক দিয়ে পুলিশকে তালা খুলে দিতে বলেন। পুলিশ তাতে সাড়া না দিলে খালেদার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও একই অনুরোধ করেন।

তাতেও পুলিশ তালা না খোলায় সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।

পরে মহিলা দলের সভানেত্রী নূরে আরা সাফা, সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, সাবেক সাংসদ রেহানা আখতার রানু, নীলুফার চৌধুরী মনি, রাশেদা বেগম হীরা, সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, সুলতানা আহমেদ ও ফরিদা ইয়াসমীনসহ কয়েকজন ভেতর থেকে কালো পতাকা হাতে ফটকে লাথি দিতে থাকেন এবং তালা খুলে দেওয়ার দাবি জানান।

এ সময় তারা স্লোগান ধরেন- ‘জিয়ার সৈনিক এক হও/ লড়াই কর’, ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন/ বন্ধ করা যাবে না’, খালেদা জিয়া ভয় নাই/রাজপথ ছাড়ি নাই’।

এক পর্যায়ে বাইরে থাকা পুলিশ পেপার স্প্রে ব্যবহার করলে মহিলা দলের নেত্রীরা সেখান থেকে সরে যান। এ সময় খালেদার গাড়ির কাচেও তরল গ্যাস ছিটকে পড়তে দেখা যায়।

মিনিট পনের পরে তারা আবারো স্লোগান ধরলে পুলিশ আরেক দফা পেপার স্প্রে করে। খালেদা জিয়াকে তখনো গাড়ির ভেতরে বসে থাকতে দেখা যায়।

ঘণ্টাখানেক গাড়িতে বসে থেকে খালেদা বেরিয়ে আসেন এবং ফটকের ভেতরে ছোট একটি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করেন।

২২ মিনিটের বক্তব্যে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণ, স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিএনপিকে কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেন তিনি।

খালেদা বলেন, “আমি গত পরশুদিন এসেছিলাম অফিস করতে। অফিস থেকে আমি অসুস্থ রিজভীকে দেখতে যাব বলে পল্টনে যাওয়ার জন্য আমার গাড়ির মধ্যে বসেছি। তার পরেই দেখি যে পুলিশ এখানে গেইট বন্ধ করে রেখেছে, গাড়ি টারি দিয়ে সব অবরুদ্ধ করে রেখেছে। কেন- আমি জানি না।”

৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়ে সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দেওয়ার পর শনিবার রাতে দলীয় কার্যালয় থেকে বের হয়ে নয়া পল্টনে যেতে চাইলে পুলিশ খালেদাকে আটকে দেয়। তখন থেকেই তিনি ওই কার্যালয়ে অবরুদ্ধ।

রোববার রাতে কার্যালয়ের সামনে নতুন করে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে পুলিশ। ১১টি ট্রাক রেখে আটকে দেওয়া হয় ওই সড়কে ঢোকা ও বের হওয়ার পথ।দুটি লরি, একটি পিকভ্যান, জলকামান ও সাঁজোয়া যান নিয়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ফটকের বাইরে ও আশেপাশে মোতায়েন করা হয়।



বেলা সোয়া ১২টার দিকে কার্যালয়ের ভেতরে খালেদা জিয়ার গাড়িটি প্রস্তুত করার সময়ই বাইরের ফটকে পুলিশ তালা দেয় বলে সেখানে উপস্থিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক জানান।

প্রথম এক রাত একদিন খালেদা জিয়া এক কাপড়ে কাটিয়েছেন বলে তার ব্যক্তিগত কর্মীরা জানিয়েছিলেন। সোমবার বিএনপি নেত্রীকে দেখা যায় অন্য শাড়িতে।

তিনি বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম একটা সমাবেশ করব।আমরা সব সময় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছি।... তারা যদি সমাবেশ করতে চায়, তারাও করতে পারত, আমরা তো এখনে কোনো আপত্তি করিনি। যার যার মতো সমাবেশ করতাম, এখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তারা আজকে আমাদের সমাবেশ করতে দিল না।”

গত বছর ৫ জানুয়ারি এই দিনটিতে নির্বাচনের নামে ‘প্রহসন’ হয়েছিল মন্তব্য করে ভোটবর্জন করা বিএনপির নেত্রী বলেন, বর্তমানে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারা ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়’।এ সরকারের অধীনে দেশে ‘সুশাসন বলে কিছু নেই’।

“আজকে আমি শুধু অবরুদ্ধ নই, গোটা দেশটাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। আজকে এই সরকার একটা জালেমি সরকার। এই সরকার শুধু দেশকে অবরুদ্ধ করেনি, দেশকে একটা কারাগারে পরিণত করেছ। এই অবস্থা চলতে পারে না।”

দেশে বর্তমানে একটি ‘অস্বাভাবিক অবস্থা’ বিরাজ করছে মন্তব্য করে খালেদা দাবি করেন, সারা দেশে ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ বিএনপির কর্মসূচি পালিত হয়েছে।আর আওয়ামী লীগের লোকজন পুলিশের সহায়তায় বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর ‘আক্রমণ’ করছে।

“এটা কোন দেশে বাস করছি আমরা। আজকে এই দেশ বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলেছে এই অবৈধ সরকার।”



খালেদা জিয়া বলেন, তিনি ‘দেশে শন্তি ফিরিয়ে আসার জন্য’ বার বার সরকারকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় আসতে বললেও ক্ষমতাসীনরা তাতে সাড়া দেয়নি।

“নির্বাচন দিতে এরা ভয় পায় কেন? একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেটাও আমরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নিতে পারি। যেটা অতীতে আমরা করেছি; ঠিক করে নেওয়া যায়। কিন্তু তারা সেই পথে না গিয়ে আজকে শুধু গুলি, টিয়ার গ্যাস, হামলা মামলা এগুলো দিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।”

পেপার স্প্রে ব্যবহার করায় ফটকের বাইরে দাঁড়ানো পুলিশের সদস্যদের শাসিয়ে দেন খালেদা। কথার ফাঁকে ফাঁকে তাকেও কাশতে দেখা যায়।

“পুলিশের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নাই। কিন্তু আজকে একটা বিশেষ জেলার পুলিশ এবং ছাত্রলীগের পুলিশরা এই পুলিশ বাহিনীর সুনাম এবং ইমেজ নষ্ট করেছে। সেটা পুলিশ বাহিনীকে বুঝতে হবে। আপনারা কেন এগুলোর মধ্যে ইনভল্ভ হচ্ছেন? পেপার স্প্রে করে কি আনন্দ পাচ্ছেন?

‘সরকারের এজেন্টদের এই বাড়াবাড়ি’ বেশি দিন টিকবে না বলেও তিনি হুঁশিয়ার করেন।

তিনি বলেন, “আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এজন্য যে, আমি কর্মসূচিতে গেলে জনগণের স্রোত নামবে। এই অবৈধ সরকার জনগনকে ভয় পায়। কারণ তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই।”

বক্তব্যের এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া বলেন, তিনি শুনেছেন একুশে টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

“এটা কোনো সমাধান নয়। এর আগেও অনেকগুলো চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে।... তারা কথা বলবে, আর অন্যরা কথা বললে টেলিকাস্ট করতে দেবে না। এটা তো গণতন্ত্রের নমুনা নয়।”

বিগত বিএনপি সরকারের সময়েও দেশের প্রথম এই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যা পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আবার সম্প্রচারে আসে।

কার্যালয়ের তালা খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, “আমরা চাই এখনই তারা সব তুলে দেবে, যাতে আমরা সমাবেশ করতে পারি।”

‘অবরুদ্ধ অবস্থায়’ কার্যালয়ে কেমন আছেন– এমন এক প্রশ্নে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “কষ্ট করে এখানে আছি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তারপরও থাকতে হচ্ছে।”

খালেদা জিয়া বক্তব্য দেয়ার সময়ে তার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান ও বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস তার পাশে ছিলেন।


চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ সৌজন্যে বিডি নিউজ/ ০৫-০১-১৫