এভাবেও দেশকে ভালোবাসা যায়! ---- সৈয়দ নাজাত হোসেন

দেশকে কেউ ভালোবাসে না এমন মানুষ সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও নেই। সন্তানের কাছে প্রিয় মা’র মর্যাদা যেমন, তারচেয়ে কোনো অংশে কম নয় এই দেশপ্রেম। মা-ই মাতৃভূমি, মাতৃভূমিই মা। অথচ এই মাতৃভূমি নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ এখন জিম্মি। রাজনৈতিক স্বার্থে বিশেষ করে গদির টানাটানিতে দাউ দাউ করে জ্বলছে দেশের সম্পদ। মরছে মানুষ। লণ্ডভণ্ড হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। সবার লক্ষ্যÑ ‘তোরা যে যা বলিস ভাই...’ আমার সোনার গদি চা-ই, চাই।
১৯৯৪ সালের কথা। ভারতে তখন কংগ্রেস সরকার। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট। মরহুম জ্যোতিবসু ছিলেন তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তার আমন্ত্রণে এক ট্রেড ফেয়ারে অংশ নিতে কলকাতা যাওয়ার সুযোগ ঘটে আমার। সার্কভুক্ত ৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ৫টি জেলার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারও এতে অংশ নেয়। এই প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিসেবে আমার এই যাওয়া। ভিসার মেয়াদ ১ মাস হওয়ায় মূল অনুষ্ঠান শেষে ভারতের কয়েকটি রাজ্য ঘুরে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। ঘুরতে গিয়ে মনে হয়েছে ভারতের এক একটি রাজ্য এক একরকম। যদি কেউ পুরো ভারত ঘুরে দেখার সুযোগ পান, তাহলে তাকে আর পৃথিবীর কোথাও ঘোরার দরকার নেই। সারা পৃথিবী যেন পুরো ভারতজুড়েই। প্রতিটি রাজ্যই যেন একেকটি দেশ। ঘুরে না দেখলে যা বিশ্বাসই করা যায় না।
পাতাল ট্রেনে ওঠা তো দূরের কথা, মাটির নিচ নিয়ে ট্রেন চলতে পারে, সে সময় এটা ভাবনাতেই ছিল বিস্ময়। কলকাতা ঘুরে ক’দিন পর সিদ্ধান্ত নিলাম পাতাল ট্রেনে ওঠার। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ধর্মতলা থেকে শুরু হওয়া এই ট্রেনের শেষ গন্তব্য হচ্ছে দমদম স্টেশন পর্যন্ত। মাঝে শুধু ১০-১২টি স্টেশন। সেই মোতাবেক ধর্মতলা গিয়ে সমতল ভূমি থেকে নিচে নামা শুরু করলাম। সুন্দর সিঁড়ি নেমে গেছে একেবারে পাতালে। যেন কোন বড় বিল্ডিংয়ের ২০ তলা থেকে নিচে নামছি। প্লাটফর্মে পৌঁছে বিস্মিত হলাম। কি সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো এই স্টেশন। ময়লার ছিটেফোটাও নেই কোত্থাও। সবই তকতকে, ঝকঝকে করে সাজানো। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলাম। টিকিটের দাম অনেকটা ঢাকার বাসের মতো, খুবই কম। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন এল। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে ট্রেনটি থামতেই ‘ঘটাং’ করে কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে গেল। মুহূর্তেই যাদের নামার তারা নামলেন, আর যাদের ওঠার তারা উঠলেন। আমিও ট্রেনে উঠে বসলাম। নেই হুড়োহুড়ি, ছোটাছুটি কিংবা হট্টোগোল। সুন্দর করে সাজানো চেয়ার। ফাঁকা চেয়ারে যে যার মতো করে বসছেন। আর যারা চেয়ার পেলেন না, তারা ঢাকার বাসের যাত্রীর মতো রিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ধাক্কা খাওয়া কিংবা পড়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। লম্বা লাইনে থরেথরে সাজানো রিং। ছেলে-মেয়ে সবাই সমান। ট্রেনটি যখন ছাড়ল, তখন মনে হলো ৭-৮ সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রেনের গতি বেড়ে একেবারে একশ কিলোমিটার বেগে ছোটা শুরু করল। পরবর্তী স্টেশনে পৌঁছাতে সময় নিল খুব বেশি হলেও ৩ মিনিট। পরবর্তী স্টেশনে ট্রেনটি যখন পৌঁছবে পৌঁছবে করছে, ঠিক তখন ট্রেনের গতিও একইভাবে কমে শূন্যের কোটায় নেমে এল। মাইক্রোফোনে ধারণকৃত বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি বক্তব্যে স্টেশনের নাম ও যাত্রীদের ট্রেনে ভ্রমণের জন্য ধন্যবাদ জানানো হলো। তারপর একইভাবেই কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে গেল। যাদের নামা ও ওঠার তারা নামলেন এবং উঠলেন। এভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দমদম স্টেশনে গিয়ে ট্রেনটি থামল। ট্রেন থেকে নেমে সিঁড়ি ডিঙিয়ে সমতলে উঠলাম। চারপাশে সবকিছু স্বাভাবিক, সুন্দর ও ফিটফাট। পাতাল ট্রেনের ভ্রমণে দারুণ তৃপ্তি অনুভব করলাম। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দেখার ইচ্ছে ছিল। সে জন্য খোঁজ নিয়ে জানলাম স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে চড়ে গেলে ভাড়া ৪০ টাকা, আর দু’শ গজ সামনে হেঁটে গিয়ে লোকাল বাসে উঠলেই ৩৫ পয়সায় একই স্থানে যাওয়া সম্ভব। খরচ কমানোর জন্যই সামনে হেঁটে গেলাম এবং লোকাল বাসে চড়ে সুভাস চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে পৌঁছলাম। ১০ টাকার টিকিট কেটে বিমানবন্দরে ঢুকলাম। বিমানবন্দরটি দেখে মনে হলোÑ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো ততটা সুন্দর না। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অনেক সুন্দর।
এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর একই পদ্ধতিতে লোকাল বাসে চড়ে দমদম স্টেশনের কাছে ফিরে এলাম। বাস থেকে নামার পর বাধল বিপত্তি। কেননা, পাতাল ট্রেনের স্টেশনটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যাকেই জিজ্ঞেস করছি স্টেশনের কথা, তিনিই বলছেন সামনে এগিয়ে যান। এগোচ্ছি বটে কিন্তু পাতাল ট্রেনের স্টেশন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষবারের মতো আরো একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেনÑ
: সামনে গিয়ে হাতের বামে যাবেন, একটু এগুলেই দেখবেন একটি ওভারব্রিজের সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলেই দেখতে পাবেন ‘দমদম স্টেশন’।
মনে খটকা লাগল এই ভেবেই যে, পাতাল ট্রেনের স্টেশন মাটির নিচে হওয়ার কথা। উপরে উঠতে বলছে কেন? কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে ঠিকই দেখতে পেলাম ‘দমদম স্টেশন’। তবে এটা ব্রডগেজের স্টেশন। পাতাল ট্রেনের দমদম স্টেশন-এ পৌঁছাতে হলে ব্রডগেজ লাইনের উপরে থাকা ওভারব্রিজ পার হয়ে নিচে নেমে তারপর মিটারগেজের স্টেশনে পৌঁছা সম্ভব। কি আর করা? সেই মোতাবেক ওভারব্রিজে উঠে নিচে নামলাম। তারপর আবারো নিচের দিকে নেমে পাতাল স্টেশনের ‘দমদম স্টেশন’ খুঁজে পেলাম। প্লাটফর্মে পৌঁছামাত্র টিটি সাহেব ছুটে এলেন। চাইলেন টিকিট। বললামÑ
: ধর্মতলা যাব, টিকিট কাটব কোথায়?
: আপনার প্লাটফর্মের টিকিট দিন।
: প্লাটফর্মের টিকিট মানে?
: প্লাটফর্মে ঢোকার টিকিট।
: বিষয়টি জানি না। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
টিটি সাহেবের কথায় বোঝা গেল প্লাটফর্মে ঢুকতে হলে ৫০ পয়সার টিকিট কাটতে হয়। হয় টিকিট কাটতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের মতো ১০/১৫ টাকা বকশিস দিলেই চলবে। ভারতীয় নাগরিকরা সে কারণে ৫০ পয়সার টিকিট কেটেই প্লাটফর্মে ঢোকেন। টিটি সাহেব এবার অনেকটা রাগান্বিত হয়েই টিকিট চাইলেন। শত অনুরোধেও কাজ হলো না।
: আপনাকে ২শ’ টাকা জরিমানা করা হলো।
: এ আপনি কি বলছেন? আমি একজন সাংবাদিক। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
: ৩শ’ টাকা।
: দেখুন, এটা অন্যায়।
: ৪শ’ টাকা।
: স্টেশন ম্যানেজার কোথায় বসেন?
: ৮শ’ টাকা।
: এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
: ১২শ’ টাকা।
যত কথা বলছি, ততই জরিমানার পরিমাণ বাড়ছে। কী আর করা? কথা না বাড়িয়ে বললামÑ
: রশিদ দিন।
বিস্মিত টিটি সাহেব ‘ফাইন’ বলা বন্ধ করে দিয়ে বললেনÑ
: টাকা দিন।
: আগে রশিদ দিন।
: বলছি তো আগে টাকা দিন।
এভাবে বার কয়েক কথা চালাচালি হতেই আশেপাশের লোকজনের জটলা বাধা শুরু হলো। একজন টিটি সাহেবকে অনেকটা তিরস্কার করেই বললেনÑ
: এই যে বাবু, ভালোই ভালো রশিদটা কেটে দিন। উনি বাংলাদেশী, আমি কিন্তু বাংলাদেশী না...
পরিস্থিতি অনুকূলে নয় ভেবে, টিটি সাহেব কোনো বিতর্কে না জড়িয়ে ১২শ’ টাকার একটি রশিদ কেটে দিলেন। বাধ্য হয়ে ১২শ’ টাকা জরিমানা দিলাম। সেই একই ভদ্রলোক আবারো বললেনÑ
: টিটি বাবু কাজটা কিন্তু খুব একটা ভালো করলেন না। ১০ টাকার টিটি আপনি, উনি বাংলাদেশী। আপনার কারণে ভারত সম্পর্কে তিনি খারাপ ধারণা পেলেন।
১২শ’ টাকা গচ্চা দিলাম বটে, ভারতীয় এই নাগরিকের আচরণে খুশি হলাম। জরিমানা দেয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, বিষয়টি স্টেশন ম্যানেজারকে অবহিত করব। কোনো লাভ হবে না, তবুও। গত ক’দিনে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে ভারতে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলে কাজ হয়। যা বাংলাদেশে খুব একটা হয় না।
শেষপর্যন্ত স্টেশন ম্যানেজারের রুম খুঁজে পেলাম। দরজায় ‘নক’ করে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলাম। অনুমতি পাওয়ার পর যা প্রত্যক্ষ করলাম তা একটু অন্যরকম। ম্যানেজার মনিলাল ঠাকুর একটি সুন্দর চেয়ারে বসে আছেন বটে, তবে তার দু’পা চেয়ারে তোলা। হালকা-পাতলা গড়ন, বয়স আনুমানিক ৫০-ঊর্ধ্ব। মুখে পান, ঠোঁট দুটো লাল হয়ে আছে। পরনে ধুতি। পান চিবুতে চিবুতে বললেনÑ
: বলুন, কী সেবা দিতে পারি আপনাকে?
: ট্রেড ফেয়ারে বাংলাদেশ থেকে এসেছি। পেশায় একজন সাংবাদিক।
: আরে আসুন, আসুন। আমার তিন পুরুষের বাড়ি বাংলাদেশের মাগুরা জেলায়। দেশবিভক্তির পর দাদা, বড়দাদা এখানে চলে আসেন। আমার জন্ম এ দেশেই। আপনি তো আমার পরম আত্মীয়। বলুন, কী সেবা করতে পারি?
প্লাটফর্মে ঘটা পুরো ঘটনা খুলে বললাম তাকে। উচ্ছ্বসিত ম্যানেজার বাবু হঠাৎ করে গম্ভীর হলেন। সুন্দর অবয়ব যেন কালো হয়ে উঠল। মনে হলো, এ ঘটনায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন।
: কইরে খগেন, কোথায় গেলি? তাড়াতাড়ি আয়। বাংলাদেশ থেকে আমার দাদা এসেছেন। চা খাওয়া।
দুুপুর তখন প্রায় আড়াইটা বাজায় চা খেতে চাইছিলাম না। কিন্তু না, চা খেতেই হবে। কিছু পর ছোট্ট মাটির কাপে চা নিয়ে এল খগেন। বাধ্য হয়ে খালি পেটে চা খেলাম। চা খেতে খেতে ম্যানেজার বাবু বললেনÑ
: দেখি, আপনার জরিমানার রশিদটা?
রশিদটা বের করে দিতেই তিনি টিটি সাহেবের স্বাক্ষর দেখে বুঝে নিলেন কাজটি কে করেছেন। বললেনÑ
: খগেন, শ্যামলকে এক্ষুণি ডাকো। ও আমার দেশি ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে।
তিনি আরো বললেনÑ
: দাদা, মনে কিছু নেবেন না। আমার অনুরোধ, দেশে ফিরে এ নিয়ে কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করবেন না। রিপোর্টটি করা হলে ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ খারাপ ধারণা পোষন করবেন।
মনে মনে বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, এটা কোন ধরনের দেশপ্রেম? এটা কী সত্যিকার অর্থেই দেশের প্রতি ভালোবাসা, নাকি ভণ্ডামি?
এরই মধ্যে ওই ঘরে এলেন সেই টিটি সাহেব। আমাকে দেখে তিনি অনেকটা অপরাধির মতো হলেন। ঝিলিক মারা চেহারায় ফুটে উঠল কালো মেঘের ঘনঘটা। ম্যানেজার বাবু বললেনÑ
: তুমি এটা কী করেছ শ্যামল?
টিটি সাহেবের মুখে কথা নেই।
: না না বলো, কাজটা কী ঠিক করেছ? গত দেড় বছরে কাউকে এমন ১২শ’ টাকা ফাইন করেছ?
: না বাবু।
তাহলে এটা করলে কেন?
কোনো জবাব নেই টিটি সাহেবের।
: উনি তার পরিচয় দেননি?
: দিয়েছেন বাবু।
: তোমার কী একবারও মনে হয়নি উনি দেশে ফিরে এ নিয়ে একটি রিপোর্ট করতে পারেন?
: ভাবতেই পারিনি বাবু, পাবলিকের সামনে উনি ১২শ’ টাকাই বের করে দিয়েছেন।
: তুমি জানতে না বাংলাদেশীরা কত ভদ্রলোক?
: জানি বাবু।
: তাহলে এটা করলে কেন?
: আমার ভুল হয়ে গেছে বাবু।
: না না এই ভুলের ক্ষমা নেই। কেন এই ভুল করেছ?
: এমন ভুল আর কোনোদিন হবে না বাবু।
কথাটি বলেই টিটি সাহেব আমার দিকে ছুটে এলেন এবং হাত দুটো জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন। আমি আর কী করি? ক্ষিপ্ত ম্যানেজার বাবু অনেক রুঢ় ভাষায় যাচ্ছেতাই বলে টিটি সাহেবকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। ম্যানেজার বাবু বললেনÑ
: দাদা, যেহেতু রশিদটা কাটা হয়ে গেছে, সেহেতু আর কিছুই করার নেই। আপনার টাকাটা টিটি নয়, ভারতীয় রেলওয়ে পেয়েছে। দয়া করে মনে কিছু নেবেন না।
এ সময় ম্যানেজার বাবু দুই হাত তুলে অপরাধীর মতো অনুরোধ করে আবারো বললেনÑ দাদা, রিপোর্টটি দয়া করে করবেন না। এটার সঙ্গে ভারতের সম্মান জড়িত।
কথা না দিলেও সম্মতি প্রকাশ না করে পারিনি। ম্যানেজার বাবু বললেনÑ
: ভিসা কত দিনের?
: ১ মাসের।
: কোথায় ঘুরবেন?
কয়েকটি প্রদেশের কথা বললাম।
ম্যানেজার বাবু বললেনÑ
: ভারতে ট্রেনের জার্নি বেশ ভাল। তবে টিকিট পাওয়া কষ্টকর। বিদেশী হিসেবে যা আপনার জানার কথাও নয়। যদি চান, তা হলে কবে কোথায় যাবেন বলুন, আপনার টিকিট কেটে দিয়ে কিছুটা ঋণ শোধ করি।
সুযোগটা নিয়ে নিলাম। আসলেই ভারতে ট্রেনের টিকিট পাওয়া বেশ কষ্টকর। যদিওবা বড় বড় স্টেশনে বিদেশীদের জন্য বিশেষ টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। এইসব স্টেশনের দোতলায় গিয়ে কাউন্টার খুঁজে পাসপোর্ট দেখিয়ে একটি ফরম পূরণ করলেই যে কোনো দিন যে কোনো জায়গার টিকিট পাওয়া সম্ভব। বললামÑ
: কাল বিকেলে অথবা রাতের ট্রেনে দার্জিলিং যেতে চাই।
: ম্যানেজার বাবু জলপাইগুড়ি স্টেশনের টিকিট কেটে দিলেন। ওখান থেকেই দার্জিলিং যেতে হয়। বিদায় নেয়ার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তিনি আবারো সেই একই অনুরোধ করলেন।
ছয় দিন দার্জিলিং ঘুরে বের হলাম আগ্রার তাজমহল, আজমির শরীফ ও দিল্লির উদ্দেশে। ৭/৮ দিনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম।
তখন ডিসেম্বর মাস। প্রচণ্ড শীত। আজমির শরীফ থেকে যে দিন বাসে করে ভোরবেলা দিল্লি পৌঁছলাম, সেদিন দিল্লির তাপমাত্রা ছিল মাইনাস চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পুরো দিল্লি শহর। সামনে কাউকেই দেখার কোনো সুযোগ নেই। বাস থেকে নেমে অনুভব করলামÑ সমুদ্রের মাঝখানে যেন নামিয়ে দেয়া হয়েছে। চারদিকে শুধু সড়ক আর সড়ক। যেহেতু কিছুই চিনি না কিংবা জানি না, সেহেতু আগে থেকে নেয়া অভিজ্ঞতায় অগ্রসর হলাম। এরই মধ্যে কয়েকটি ট্যাক্সি ছুটে এল। ভাঙা হিন্দিতে বললামÑ
: জামে মসজিদ যাবেন?
: যাব।
: ভাড়া কত?
: ৪০ টাকা।
: ৩০ টাকায় যাবেন?
: না, ভাড়া ৪০ টাকায়।
আরো ২/৩ জন ট্যাক্সিচালক একই ভাড়া চাইল। সে কারণে একটি পছন্দসহ ট্যাক্সি নিয়ে জামে মসজিদ এলাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। ট্যাক্সি চলছে তো চলছেই। ডান, বাম, সোজা পথ ধরে ট্যাক্সি যে কোথায় ছুটে চলেছে, তা বোঝা মুশকিল। মনে মনে অনুভব করলাম, ছিনতাইকারীর কবলে পড়লাম না তো? প্রায় এক ঘণ্টা চলার পরও ট্যাক্সিচালকের পথ যেন শেষই হচ্ছিল না। হুট করে মনে পড়লÑ ঢাকার ট্যাক্সিচালকদের কথা। নির্ঘাত এটা ঢাকা শহর হলে চালকরা এই পথের ভাড়া নিত কম করে হলেও ৪-৫শ’ টাকা। আরো প্রায় ১৫/২০ মিনিট চলার পর হুট করে একটি হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ট্যাক্সিটি। চালক বললÑ
: স্যার, জামে মসজিদ এলাকায় এসে গেছি। কোথায় যাবেন?
: হ্যাঁ, এখানেই।
ট্যাক্সি থেকে নেমে একটি হোটেলের সামনে গেলাম। দরজা বন্ধ থাকায় কলিংবেল চাপলাম। কিছু পর ঘুমজড়িত চোখে একজন দরজা খুলল।
: কী চাই?
: এটা হোটেল না?
: হ্যাঁ।
: সিট আছে?
: কোথায় থেকে এসেছেন?
: বাংলাদেশ থেকে।
: ‘বাংলাদেশ’ শোনামাত্রই হুট করে যেন নাকের উপর একটি আঘাত করে দরজাটি বন্ধ করে দিল লোকটি। আমি বিস্মিত। এটা কী হলো? গেলাম পাশের হোটেলে। একই অবস্থা সেখানেও। এভাবে ৪/৫টি হোটেলে যখন একই আচরণ প্রত্যক্ষ করলাম, তখন মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। চালকও ততক্ষণে আমার অবস্থা বুঝে গেছে। বললÑ
: চিন্তা করবেন না স্যার। আমার সঙ্গে আসুন, আপনার হোটেলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
কোনো উপায় না দেখে আবারও ট্যাক্সিতে উঠলাম। চলার পথে চালক যা বলল, তাতে বাংলাদেশী হিসেবে প্রচণ্ড অপমাণিত হলাম। ও যা বলল, তা মোটামুটি এমনÑ
দীর্ঘদিন থেকে কিছু নারী পাচারকারী বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার করে এনে এসব হোটেলে উঠত। বিষয়টি জানাজানি হলে দিল্লি পুলিশ এসব হোটেলে রেড দিয়ে নারীসহ পাচারকারীদের আটক করে। এ কারণেই হোটেল কর্তৃপক্ষ আর বাংলাদেশীদের হোটেলে সিট দিতে রাজি হয় না।
কী আর করা? ট্যাক্সিড্রাইভার মনোনীত একটি হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নাম ‘ডি-রোজ’। ভাড়া সাড়ে ৩শ’ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। পাসপোর্ট জমা দিয়ে সাড়ে ৩শ’ টাকা পরিশোধ করে হোটেলে উঠলাম। চালককে বকশিসসহ মোট ১শ’ টাকা দেয়ায় সেও মহাখুশি। লাগেজ নিয়ে যখন দোতলায় উঠলাম তখন প্রত্যক্ষ করলাম, বোর্ডার নিয়ে আনার জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ চালককেও ৫০ টাকা বকশিস দিল।
হোটেলের রুমটি দেখে মন ভরে গেল। সুন্দর। বিছানায় মখমলের চাদর। ওয়্যারড্রব। মেহেমানদের বসার জন্য সোফাসেট। বাথরুমে গরম পানি। আর কী চাই? প্রথমে গরম পানি দিয়ে গোসল করে হালকা হলাম। রাতের নির্ঘুম ক্লান্তিটাও দূর হয়ে গেল। ৭টার দিকে বের হলাম নাস্তা খাওয়ার জন্য। প্রচণ্ড শীতে দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছিলাম। হোটেলের সামনেই ভ্রাম্যমাণ হোটেল। দেখতে অনেকটা ঢাকার বেইলি রোডের ফুচকা বিক্রেতাদের মতো। রুটি, পাউরুটি, ডিম, ভাজি সবই আছে। এক দোকানি অবাক করে দিয়ে বাংলায় বললÑ
: এই যে দাদা, এদিকে আসুন। এখানে বাংলাদেশী ভালো নাস্তা হবে।
ভ্রাম্যমাণ এমন অনেক হোটেলের মধ্যে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুঝলাম প্রায় সবাই ওই বাংলাটুকুই জানেÑ এর বেশি নয়। সবই হিন্দি। নাস্তা খেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম সারাদিন দিল্লি ঘুরে রাতের ট্রেনে বোম্বে যাব। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক টিকিট কাটার জন্য খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করলাম। জানলাম, হোটেল থেকে ৪/৫শ’ গজ সামনে হেঁটে গেলে দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন। ওখানে বোম্বের টিকিট পাওয়া যাবে। পায়ে হেঁটে স্টেশনে পৌঁছলাম। তারপর দোতলায় উঠে পাসপোর্ট দেখিয়ে ফরম পূরণ করে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার বোম্বের টিকিট কাটলাম। পরে আবারও ফিরে এলাম হোটেলে। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে একটি মাইক্রো ভাড়া করে নিলাম। যে সারাদিন দিল্লির বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরিয়ে দেখাবে এবং সন্ধ্যায় ট্রেনে তুলে দেবে। সব মিলিয়ে ৪শ’ টাকা ভাড়া। রাজি হলাম এবং ৯টায় হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম।
চমৎকার শহর দিল্লি। চারিদিকে প্রাচীন আমলের লাল লল সব ঘরবাড়ি আর নতুন নতুন অট্টালিকা। বড় বড় সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে গাড়ি চলছে। ওভারটেক করার কোনো প্রবণতা নেই কারো। সবাই ছুটছে তার নিজ নিজ গন্তব্যে।
চালক সোমনাথ সিং। মাথায় পাগড়ি। বাড়ি পাঞ্জাবে। হিন্দি আর ইংরেজির সংমিশ্রণে কথা বলে। পুরো দিল্লি তার নখদর্পে। ৫/৬ বছর থেকে ও এই শহরে মাইক্রো চালায়। তার ড্রাইভিং লাইসেন্সও রয়েছে। ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে দিল্লি শহরে কেউ গাড়ি চালাতে পারে না।
মাইক্রো চলছে। সোমনাথ বলেই চলেছে, এটার নাম এই, ওটার নাম ওই। সবই দিল্লির ঐতিহ্য।
প্রথমেই গেলাম দিল্লি প্রেসক্লাবে। ঢাকা প্রেসক্লাবের তুলনায় অনেক সুন্দর। বেশ সকাল থাকায় সাংবাদিক উপস্থিতির সংখ্যাও অনেক কম। যে ২/৩ জন সাংবাদিকের সাক্ষাত হলো, তারা বেশ আন্তরিক। চা খাওয়ালেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা বিষয়ে জানতে চাইলেন। পরে তারা চালক সোমনাথকে দিল্লি ঘুরে দেখানোর বেশ কয়েকটি পয়েন্ট জানিয়ে দিলেন।
প্রেসক্লাব থেকে বের হয়ে রওনা হলাম কুতুব মিনার দেখার উদ্দেশ্যে। দিল্লি শহর থেকে এই কুতুব মিনারের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। কুতুব মিনার দেখার পর ফিরে এলাম ‘দিল্লি গেট’-এ। দিল্লি গেট মানে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ মন্ত্রীদের সচিবালয়। ওখান থেকে গেলাম কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাসভবনে। ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। গেটসহ পুরো বাড়ি সেনাবাহিনীতে ভরা। পাশেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীর মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। ঢুকলাম ভেতরে। ঢুকতেই কানে ভেসে এলো বাংলাদেশের পরম বন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর যার অবদান সবচেয়ে বেশি, সেই আপনজন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রেকর্ডে ধারণকৃত ভাষণ। যা অনবরত বেজেই চলেছে। মিউজিয়ামে দেখলাম বুলেট ও বোমায় বিদ্ধস্ত রাজিব গান্ধীর রক্তাক্ত পোশাক, কেড্স। যা সুন্দর করে কাঁচের বাক্সে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ যেন নির্মমতার উৎকৃষ্ট স্মৃতি। ওখান থেকে গেলাম স্মৃতিস্তম্ভ এলাকায়। যেখানে ভারতের প্রাক্তন নেতা-নেত্রীর স্মৃতিচিহ্ন মার্বেল পাথর দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
দুপুরে একটি হোটেলে ভাত খেলাম। সঙ্গে সোমনাথও। কোনোভাবেই ও খেতে রাজি হচ্ছিল না। এককথায় জোর করেই ওকে খাওয়ালাম। খাওয়া শেষে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দিল্লি শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সাড়ে ৫টার দিকে হোটেলে ফিরলাম। উদ্দেশ্য, হোটেল থেকে লাগেজ ও পাসপোর্ট নিয়ে স্টেশনে যাব। হোটেল ম্যানেজার এ সময় পাসপোর্ট দিলেন বটে, সঙ্গে একটি বিলও ধরিয়ে দিলেন। যাতে লেখা রয়েছে ৭শ’ ৩০ টাকা। জিজ্ঞেস করলামÑ
: কিসের বিল?
: হোটেলে থাকার বিল।
: আমি তো সকালেই বিল পরিশোধ করেছি।
: গতকাল থেকে আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত একদিনের ভাড়া। পরেরটা ভ্যাটসহ মিলে মোট ৭শ’ ৩০ টাকা। ইচ্ছে করলে আপনি কাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত এখানে থাকতে পারেন।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ব্যাটা বলে কী? অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোন কাজ হলো না। ৭শ’ ৩০ টাকাই দিতে হবে। বললামÑ
: এটা অন্যায়।
: নিয়ম অনুযায়ী ভাড়া নেয়া হয়েছে।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও কোনো লাভ হলো না। কেন জানি বলে ফেললামÑ
: হোটেলের রেট কার্ডটি দিন।
ম্যানেজার যে রেট কার্ডটি বের করে দিলেন তার কোথাও সাড়ে ৩শ’ টাকা ভাড়া উল্লেখ নেই। আছ ৩শ’ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বললামÑ
: ভাড়া ৩শ’ টাকা, আপনি সাড়ে ৩শ’ ধরলেন কেন?
: ভাড়া বেড়েছে।
: ভাড়া বাড়ানোর কথা এখানে উল্লেখ নেই কেন?
: আমার প্রশ্নে ম্যানেজার বিরক্তি হলেন এবং খারাপ ব্যবহার করা শুরু করলেন। বুঝলাম সকালে যে ট্যাক্সিচালককে ৫০ টাকা দেয়া হয়েছে, তা আমার উপর দিয়েই কেটে নেয়া হলো।
শেষপর্যন্ত কোনো অনুরোধই যখন কাজে লাগল না, তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে বললামÑ
: একটা ফোন করতে পারি?
ম্যানেজার টেলিফোনটি এগিয়ে দিলেন। বাংলাদেশে ১৭ নম্বরে ফোন করে যেমন কোনো টেলিফোন গ্রাহক কিংবা প্রতিষ্ঠানের নম্বর জানা যায়, ঠিক তেমনি ভারতে ১৬৯ নম্বরে ফোন করে যে কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা গ্রাহকের নম্বর জানা সম্ভব। যা ইতিপূর্বে জেনেছি।
১৬৯ নম্বরে ফোন করে দিল্লির ডিএম অর্থাৎ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নম্বর জানতে চাইলাম। মুহূর্তেই ডিএম, দিল্লির নম্বর দেয়া হলো। ফোন করলাম সেই নির্দিষ্ট নম্বরে। ফোন রিসিভ করেই একজন ইংরেজিতে বললেনÑ
: কে বলছেন, দয়া করে পরিচয়টা দিন।
: বাংলাদেশ থেকে এসেছি। পেশায় একজন সাংবাদিক। একটি সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছি জন্যই ডিএম সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিএম সাহেবের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দেয়া হলো। ডিএম সাহেব বললেনÑ
: শুভ বিকেল। বলুন স্যার, কী সেবা দিতে পারি?
ভোর থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত ঘটা সব ঘটনা ডিএম সাহেবকে খুলে বললাম। লক্ষ্য করলাম, ম্যানেজারের চোখ ততোক্ষণে কপালে উঠেছে। ডিএম সাহেব বললেনÑ
: দুঃখিত। হোটেল কর্তৃপক্ষ আপনার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। অনুগ্রহ করে হোটেলের নাম ও ঠিকানাটা দিন। রেটকার্ডে উল্লেখ থাকা নাম ও ঠিকানা ডিএম সাহেবকে জানালাম। শেষে তিনি আমার ঠিকানাটাও জেনে নিলেন। শেষপর্যন্ত পুরো টাকা পরিশোধ করে মাইক্রোতে উঠলাম। যেখানে টিকিট কেটেছিলাম, চালক সোমনাথকে সেখানে নিয়ে যেতে বললাম। সন্ধ্যা সোয়া ছ’টায় স্টেশনে পৌঁছে বিস্মিত হলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, যেখান থেকে টিকিট কেটেছি, সেই স্টেশনের নাম ‘দিল্লি স্টেশন’। ট্রেন ছাড়বে ‘নিউ দিল্লি’ স্টেশন থেকে। মাথা খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে থাকা সোমনাথও সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করছিল। ও আশ্বস্ত করে বললÑ
: স্যার, ঘাবড়াবেন না। জলদি গাড়িতে উঠুন। ট্রেন ধরিয়ে দিচ্ছি।
কী আর করা? সোমনাথের পিছু পিছু ছুটলাম। সোমনাথ তার মাইক্রো নিয়ে ছুটল নিউ দিল্লির উদ্দেশে। ২/৩ মিনিট হাতে থাকতেই ও ঠিকই স্টেশনে গিয়ে পৌঁছাল। তাড়াহুড়ো করে মাইক্রো থেকে নেমে সোমনাথকে ৫শ’ টাকার একটি নোট দিয়ে ১শ’ টাকা বকশিস নিতে বললাম। এবার সোমনাথও আমার গতি থামিয়ে দিল। বললÑ
: স্যার, তুমি ভিনদেশী। হোটেল কর্তৃপক্ষ তোমার সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তাতে তোমার মন খারাপ হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। সাংবাদিক হিসেবে তুমি যখন এ বিষয়ে তোমার দেশে ফিরে লিখবে, তখন ‘আমার ভারত’ অনেক ছোট হয়ে যাবে। আমি তোমার বকশিস নিতে পারছি না জন্য দুঃখিত। আমার অনুরোধ যদি সম্ভব হয়, তাহলে বিষয়টি ভুলে যেও, কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করো না। বলেই সোমনাথ জোর করে বকশিসের ১শ’ টাকা ফেরত দিয়ে দিল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ট্রেন ধরব, নাকি মাটিতে বসে পড়ব, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
পুরো ১ মাস ভারত ঘুরে দেশে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে অফিসের টেবিলে জমে থাকা চিঠিগুলো এক ঝলক দেখে নেয়ার সময় চমকে উঠলাম। প্রায় ৫০/৬০টি চিঠির মধ্যে একটি চিঠি ডিএম, দিল্লির। তাড়াতাড়ি খামটা খুলে যা পড়লাম, তাতে স্তম্ভিত না হয়ে পারলাম না। ডিএম সাহেব লিখেছেনÑ
: একজন পর্যটক হিসেবে টেলিফোনে যে অভিযোগ করেছিলেন, তা তদন্ত করে দেখা হয়েছে। তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ‘ডি-রোজ’ হোটেলের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি অবগতির জন্য প্রেরণ করা হলো।
ডিএম, দিল্লি সেই চিঠির অনুলিপি ভারতীয় হাইকমিশনার, ঢাকা ও সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশকেও দিয়েছেন।
অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে আমরা এখন কোথায় বসবাস করছি? উচ্চস্বরে শুধু বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ পোশাক পরে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, শহীদ মিনার আর স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়েই কী সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসা যায়? প্রকৃত দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কবে সৃষ্টি হবে? আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?