সঙ্কটে চাঁপাই আদিবাসীরা


চতুর্মুখী শঙ্কটে সমাজে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে চাপাইনবাবগঞ্জের
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা (আদিবাসী) । অবস্থার উত্তোরণে বহুবার নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান তেমন কোনো আগ্রগতি হয়নি। জীবন ঘণিষ্ঠ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ । ফলে দেশের আর্থ সামাজিক অগ্রগতির ধারায় অন্য সবাই এগিয়ে গেলেও নানান বঞ্চনায় পিছিয়ে পড়ছেন তারা । মহল বিশেষের হামলা-নির্যাতনের শঙ্কায় নিরাপত্তাহীনতা এ জনগোষ্ঠীর বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে জেলার দুই সাংসদ ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের (আদিবাসী) জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।  বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের চাহিদা নিয়ে আমরা সব সময় কাজ করি।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তিনটি সংসদীয় আসনে বিভাক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট) এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (জেলা সদর) আসন এলাকায় রয়েছে
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (আদিবাসী জনগোষ্ঠীর) বসবাস । দুটি আসনে প্রায় পৌঁনে এক লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভোটার সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার । রাজনীতি সচেতন স্থানীয় সিনিয়র নাগরিকদেও মতে, নির্বাচন এলেই আদিবাসী ভোট ব্যাংকের গুরুত্ব বাড়ে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এ ভোটারদেও প্রতি বিশেষ নজর থাকে সব প্রার্থীর। তাদেও সমর্থন আদায়ে দেওয়া হয় বহুমুখী প্রতিশ্রুতি। সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আসন দুটিতে নির্বাচিত দু’জনই অতীতেও সাংসদ ছিলেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়ন হবে তার জন্য আগামী পাঁচ বছর অপেক্ষার পালাশুরু হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভোটের আগে এক সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নেতারা ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বাধীন ভূমি কমিশন, পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন, সরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষায় কোটা নির্ধারণসহ জমি, জলাধার, সমাধিস্থান রক্ষার দাবি জানান। একই সাথে আদিবাসী ঘন এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সেবা এবং সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় দেওয়া সুবিধাসমহাওে নিশ্চিত করার ওপর গুরুদ্বারোপ করেন। হামলা, মামলা, নির্বযাতন ও অপহরণ বন্ধসহ আইনী নিরাপত্তা বিধানে সংসদের সংরক্ষিত আসনে উত্তরবঙ্গ থেকে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব চেয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।
অন্য বারেরমত এবারের নির্বাচনের প্রচারণা ও গণসংযোগে প্রার্থীরা আদিবাসীদেও এসব দাবিবাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা। 

 বাবুডাইং এলাকার আদিবাসী নারী রুমালী হাসদা বলেন, নির্বাচনের আগে ভোট ব্যাংক হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও ভোটের পরে সব চেয়ে বেশি অবহেলা ও নিপীড়নের শিকার হতে হয় আদিবাসীদের। দেশের সর্বত্র উন্নয়ন হলেও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার সড়কগুলো এখনো কাঁচা। নেই সুপেয় পানি ও পয়ঃনিস্কাশনের যুগসই ব্যবস্থা। ন্যূনতম চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা না থাকায় আদিবাসী নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বঞ্চিত আদিবাসীদেও মধ্যে দারিদ্র্যেও হারও বাড়ছে দিন দিন।
 নৃ-গোষ্ঠীর  নেতা হিংগু মুরমু জানান, নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের বাসুগ্রাম, কার্ত্তিকপুর, ধরইলশ্যামপুর, ধরইল, জমিনকমিন, নতুনপাড়াসহ ৬ গ্রামে যুগের পর যুগ কোনো বিদ্যালয়না থাকায় শিক্ষার্থীদেও সাত কিলোমিটার দূওে গিয়ে পড়ালেখা করতে হতো। তবে এই এলাকায় একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও জানান এই নেতা। অন্যদিকে বাবুডাইং এলাকায় সরকারি কোন বিদ্যালয় না থাকলেও কয়েক বছর আগে একটি ট্রাস্টের অধিনে আলোর পাঠশালা নামে স্কুল চালু হয়।

গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউপির মিরাকাঠাল গ্রামের সাঁওতালদের নেতা জগদী শসরেন বলেন, “চাড়ালডাঙ্গা মোড় থেকে বাঙ্গালীদের গ্রাম পর্যন্ত পাকা রাস্তা এসে থেমে গেছে। কাঁচা সড়ক পাকা করার প্রতিশ্রুতি শুনেই আসছি। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। বরং আমাদের বহু পুরোনো শ্মশান, খ্রিষ্টানদের কবরস্থান ও কালীমন্দির থেকে তাঁদের উচ্ছেদেও অপচেষ্টা হচ্ছে বারংবার।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রয়ক মিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বিচিত্রা তির্কী জানান, জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় নানা ধরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও নির্বাচিত হয়ে আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেন না। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন তো দূরের কথা অনেক জীব ঘনিষ্ট বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ারও নজির খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. প্রভাত টুডু বলেন, “ধর্মীয়সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কখনওই তারা নির্ভয়ে সামাজিক ভাবে বসবাস করতে পারেন না।  বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল এসব মাসুষদের উপর নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অনেক ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। ”উত্তরবঙ্গে প্রায় ৩২টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দূর্দশা, তাদের দাবি-দাওয়া ও চাহিদার কথা বলার মতো কেউ নেই। ফলে শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে এই নেতা জাতীয় সংসদেও সংরক্ষিত আসনে আদিবাসীদেও প্রতিনিধি রাখার দাবি জানিয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন জুয়েল বলেন, জেলায় আদিবাসীদের উপর জমিজামাকে কেন্দ্র কওে বিভিন্ন সময়ে হামলা হয়েছে। ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে সরকার ও প্রশাসকে কাজ করা উচিত। সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি পরিষেবা পরিষেবাগুলো বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন সুজনের জুয়েল।

ক্ষুদ্রজাতিসত্বার জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ -২ সংসদীয় আসনে বারবার নির্বাচিত সাংসদ মুঃ জিয়াউর রহমান তার এলাকার জনগণের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেছেন। অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন লাগসই অবকাঠামে উন্নয়নে। জেলা আওয়ামীলীগে সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া এই এমপি দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে রহনপুরকে রেলবন্দওে রুপান্তর এবং বিলভাতিয়ায় কৃষি ভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছেন।
প্রসঙ্গতঃ সংসদ সদস্য মু. জিয়াউর রহমান বলেন, “সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সকলের জন্য কাজ করি। আগামীতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গ্রামের সড়কগুলো যেন কাঁচা না থাকে, সে ব্যবস্থা করা হবে। আসনটির আদিবাসীদেও জমিনকমিন গ্রাম থেকে কার্তিকপুর পর্যন্ত সড়কটি পাঁকা করা হবে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

সদর আসন থেকে চতুর্র্থ বারেরমত নির্বাচিত সাংসদ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল ওদুদ চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আধুনিক বাসযোগ্য শহরে রূপান্তরের পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। সোনামসজিদ দ্রুত তথ্য প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা, স্থল বন্দর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ, ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগড়ে তোলার মাধ্যমে আদিবাসীসহ সকলের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকারের তালিকার প্রথম দিকের রেখেছেন বলেও জানিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আইন সভার এই সদস্য।  
এক প্রশ্নোত্তরে সাংসদ ওদুদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আদিবাসীদেও চাহিদা নিয়ে আমরা সব সময় কাজ করি। তারা যেসব এলাকায় বসবাস করে সেসব জমিগুলো খাস। এসব জমি তাদেও নামে বরদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করা হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ভাতাভোগ করেন বলেও জানান আব্দুল ওদুদ।


চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ মোঃ আসাদুল্লাহ/ ২২ জানুয়ারি, ২০২৪