রহনপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম বাবু’রঘোনে অনুষ্ঠিত হল বর্ণিল নবান্ন উৎসব

শিশু থেকে তরুণী সবাই পড়েছেন লালপেড়ে হলুদ শাড়ী। মাথায় কাগুজে ফুলের মালা। হাতে রাঙা মেহেদিতে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ গীতের আওয়াজ। আর বাতাসে পিঠা-পুলির ঘ্রাণ। সব মিলিয়ে গ্রামে ঢুকতেই পাওয়ায় গেল প্রাণবন্ত উৎসবের আমেজ।
গল্পটি পূনর্ভবা নদী ঘেরা বাবুরঘোন গ্রামের। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার ছোট্ট এই গ্রামেই শনিবার হয়ে গেল নবান্ন উৎসব। গ্রামের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কথা বিবেচনা করেই অগ্রাহায়ণে নয়, বরং পোষ মাসেই আয়োজন করা হয়েছে বর্ণিল এই উৎসবের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নানান আয়োজন।
কলসি কাঁকে নদী থেকে পানি আনা, পানি আনতে গিয়ে নদীর তীরে সখিদের নিয়ে গীত ও নৃত্য করা, গোলা (কুঁঠি) থেকে ধান বের করা, সেই ধান প্রথমে ঢেঁকিতে কুটিয়ে (ভাঙিয়ে) চাল বের করা, তারপর যাঁতায় সেই চাল পিষে আটা বের করা থেকে বাড়ির আঙিনায় দলবদ্ধ হয়ে বসে পিঠা-পুলি বানানো আর গীত পরিবেশন -এ সবই ছিল ওই নবান্নের আয়োজনে। বিকালে গ্রামের একটি ফাকা মাঠে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সেখানে গান, নাচ, আবৃত্তিসহ ছিল নানান পরিবেশনা।
বর্ণাঢ্য এই পরিবেশনার সময় উপস্থিত ছিলেন, সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান, অধ্যাপক সাদেকুল ইসলাম, সংগঠক মুসলেহ উদ্দীন বাবু প্রমুখ।

গত আট বছর ধরে নিয়মিতই হয়ে আসছে এই উৎসব। বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের সময় থেকেই এই উৎসবের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই সময় বাড়ি বাড়ি থেকে ধান সংগ্রহ করা হয় উৎসবের জন্য। গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারই উৎসবে অংশ নিতে ধান দেন। সেই ধান থেকেই মূলত বানানো হয় পিঠা-পুলি। আর এই উৎসবের তত্ত্বাবধান করেন ওই গ্রামের স্কুল শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। তাকে সহযোগিতা করেন তার বোন শামীমা বেগম।
আয়োজনকে ঘিরে সকাল থেকেই বাবুরঘোণ গ্রামে ছিল উৎসবের আমেজ। মমতাজ বেগমের বাড়িতে জড়ো হন গ্রামের তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারীরা। বাড়ির আঙিনায় গোল হয়ে বসে তারা বিভিন্ন ধরণের পিঠা বানান। পিঠা বানাতে বানাতে সমস্বরে গান পিঠা বানানোর গান। তেলপিঠা, ভাপাপিঠা, পুলিপিঠা, দুধপিঠাসহ বাহারী নামের পিঠা বানানো হয়। বাড়িতে যখন ওই আয়োজন চলছে তখন তরুণীরা দলবেধে নদীতে যায় পানি আনতে। সেখানেও গাওয়া হয় পানি আনার গান। দেখানো হয় নাচও। এরপর প্রতীকিভাবে দেখানো হয় ঢেঁকিতে ধান ভানা ও যাঁতায় আটা পেষা। শেষে বানানো পিঠা ভাগ করে দেয়া হয় অংশগ্রহনকারীদের মাঝে।
উৎসবে অংশ নেয়া তরুণী নাজনীন আক্তার, মুন্নী খাতুনসহ অন্যরা জানান, এই দিনটিকে ঘিরে রীতিমত উৎসবের আমেজ বয়ে যান গোটা গ্রামের। এই দিনে তারা অনেক মজা করেন। বিশেষ করে প্রত্যেকটা কাজের সঙ্গে যে আলাদা আলাদ গীত গাওয়া হয়, সেটা খুবই উপভোগ্য একটা বিষয়। গ্রামের শিশু ও তরুণীরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।
ওই গ্রামে বাড়ি নন, তবুও উৎসবে অংশ নিয়েছেন রহনপুরের স্কুল শিক্ষিকা শাপলা বেগম। তিনি জানান, আসলে প্রাণের টানেই এই উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন তিনি। যদিও তিনি আমন্ত্রিত অতিথি, কিন্তু এই উৎসবটা তিনি দারুণভাবে উপভোগ করেন। অজ পাড়াগাঁয়ে এমন একটি নবান্ন উৎসবে যোগ দিতে পেরে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বলেও মন্তব্য করেন।
সাত বছর আগে যখন মমতাজ বেগম ও শামীমা বেগম এই উৎসব উদযাপন শুরু করেন তখন খুব একটা সহজভাবে নেয়নি গ্রামের মানুষ। ধর্মীয় অনুশাসনের অপব্যাখ্যা দিয়ে এই উৎসবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টাও করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সেটা হতে দেন মমতাজ ও শামীমা। উৎসবের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করেন মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘সংস্কৃতি একটি জাতির মেরুদ-। তাই জাতিকে রক্ষা করতে হলে সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি অনেকটাই বিলুপ্তির দিকে। গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ গীত ও পিঠা-পুলিশর উৎসব যখন হারাতে বসেছিল তখনই আমরা এসব রক্ষার সংগ্রাম শুরু করি। এখন গ্রামের মেয়েরা শতাধিক গ্রামীণ গীত গাইতে পারে। অনেক ধরণের পিঠা-পুলি বানাতে পারে। কিন্তু একদিন তাদের কাছে এসব রূপকথার গল্পের মতো ছিল।’
মমতাজ বেগম জানান, এ সব গ্রামীণ সংস্কৃতির চর্চা হলে অপরাধ প্রবণতা কমবে। নারীরা তাদের ঘরে মর্যাদা পাবে। দেশের গ্রামে গ্রামে এই সংস্কৃতি চর্চার প্রবণতা শুরু হোক এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ২৩-১২-১৭

,