শিশু এ্যাডভেঞ্চার > খালার বাড়ি যেতে গিয়ে ভুল ট্রেনে দিনাজপুর

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে নামোশংকরবাটি সর্দারপাড়ার দু’ শিশুর রহস্যময় নিখোঁজকে ঘিরে রোমাঞ্চকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ব্যক্তির ভুল তথ্য ও নিখোঁজ দু’ শিশুর চতুর কথাবার্তায় উদ্ধার অভিযানে পুলিশকে বেগ পেতে হয়েছে। পুলিশের সফল অভিযানের পর মঙ্গলবার উদ্ধার ওই দু’শিশুকে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার নামোশংকরবাটি সর্দার পাড়া গ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র সায়েম (১১) ও দক্ষিণ চরাগ্রামের শীষ মোহাম্মদের ছেলে ইমন (১২) শনিবার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। এরপর পরিবারের পক্ষ শুরু হয় বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়ি, রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন এলাকা।
দু’ শিশু হটাৎকরে নিখোঁজ হওয়ার খবরের প্রেক্ষিতে সর্দার পাড়া এলাকায় খোঁজ নিতে গেলে এলাকাবাসীরা জানায়, নামোশংকরবাটি মিরের খোল্যান এলাকায় শুক্রবার অনুষ্ঠিত বিএনপি’র জনসভা পরবর্তী পিকনিক খাবার কথা বলে তাদের মহানন্দা নদীর শেখ হাসিনা সেতু এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওইদিন ওই এলাকার আরো কয়েকজন শিশু পিকনিকস্থলে গেলেও সায়েম ও ইমন ছাড়া অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। অপহরণের শিকার সায়েমের পরিবারেররও অভিযোগ ছিল, স্থানীয় ভোলা নামের একব্যক্তি সায়েম ও ইমনকে পিকনিক খাওয়ার নাম করে নিয়ে গিয়ে অপহরণ করেছে।
এঘটনায় সায়েমের পিতা আব্দুল হান্নান শনিবার রাতে ধারাবাহিক ঘটনাক্রম উল্লেখ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়রি করেন।
পুলিশ জানায়, সাধারণ ডায়েরির পরপরই পুলিশ তৎপরতা শুরু করে। সন্দেহভাজন হিসেবে প্রথমেই আটক করা হয় পিকনিকের দাওয়াত নিয়ে দু’ শিশুকে নিয়ে যাওয়া ভোলাকে। সদর থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি সাবের রেজা আহম্মেদ জানান, ভোলার অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে প্রথমে পুলিশ ধু¤্রজালের মধ্যে পড়ে। ওসি বলেন, ‘ আটক ভোলা প্রথমে জানায় তাদেরকে (দু’ শিশুকে) পিকনিকের নিয়ে যাওয়ার পর অপহরণকারীরা চাকু দেখিয়ে তুলে নিয়ে চলে যায়’।
ভোলার এমন স্বীকারোক্তিতে পুলিশ রাতভর ভোলার কথা অনুযায়ী রাজশাহীর তানোর উপজেলার অন্তত ৫ যায়গায় অভিযান চালায়। এমনকি তানোরের একটি বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকেও তল্লাশী চালায়।
এরই মাঝে খবর আসে দু’ শিশু দিনাজপুরে অবস্থান করছে। সেই খবরের সূত্রধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার এসআই রাশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল দিনাজপুর রওনা দেন। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানার একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ওই দু’ শিশুকে।
দু’ শিশু উদ্ধারের পর বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা। রোমঞ্চকর সব তথ্য।
উদ্ধার হওয়া সায়েম চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ ডটকমকে বলেন, ‘ বাড়িতে না জানিয়েই আমি আর ইমন আমার খালার বাড়ি রাজশাহী যাওয়ার জন্য বের হই। ট্রেনে উঠার পর যখন ট্রেন থেমে যায় তখন ট্রেন থেকে নেমে দেখি যে সেটা দিনাজপুর। তখন স্টেশনের পাশে এক রিক্সা ভ্যান চালককে বাড়ি থেকে (চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে) চলে আসার কথা বললে সে আমাদেরকে তার বাড়িতে নিয়ে যায় এবং আমি আমার বাড়ি মোবাইল ফোন নম্বর দিলে সে (ভ্যান চালক) বাড়িতে ফোনে কথা বলে’। সায়েম জানায়, তাদের কাছে কোন টাকা ছিলনা। রিক্সা ভ্যানওয়ালাও তাদেরকে বিনা ভাড়ায় নিয়ে গেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার এসআই রাশেদুল ইসলাম জানান, বাড়ি থেকে শুধু দু/একটা গরম কাপড় নিয়ে বের হওয়া ওই দু’ শিশুর কাছে তেমন কোন টাকাই ছিলনা। তারা দিনাজপুর স্টেশনে নেমে দু’জনে ওই এলাকা ঘুরাফিরা করে। এসময় একটি রুটি কিনে দু’জন মিলে ভাগ করে খায়। পরে তারা রিক্সা ভ্যানওয়ালকে স্বপ্নপুরি যাওয়ার কথা বললে ভ্যানওয়ালার সন্দেহ হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রিক্সা ভ্যানচালক যখন জানতে পারে যে তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ভুল করে চলে এসেছে তখন তাদেরকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। তিনি জানান, ভ্যানচালকের বাড়িতে গিয়ে একজন অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।
পুলিশ সুত্র জানিয়েছে, ট্রেনযোগে ভুল করে দিনাজপুরে চলে যাওয়া সায়েম ও ইমন তাদের পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময়ও চতুরতার আশ্রয় নেয়। মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে। তবে, ওই ফোন কলের সূত্র ধরে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানা পুলিশের সহযোগিতায় দু’ শিশুকে উদ্ধার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে আসে।
নামোশংকরবাটি এলাকার সাধারণ মানুষ দু’ শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে ‘অপহরণ’ বিষয় নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিল। কিন্তু আসল ঘটনা বেরিয়ে আসার পর দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সায়েমের গৃহ শিক্ষক চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ ডটকমকে বলেন, ‘ সায়েম এলাকার অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে আলাদা। একটু চালাক প্রকৃতির। অন্যদিন পড়তে এসে তাড়াতাড়ি করতো। কিন্তু সেদিন কোন কিছু বলেনি। পড়া শেষ করেই বাড়ি ফিরে গেছিল’। এদিকে, সঙ্গে যাওয়া ইমন হচ্ছে সায়েমের আত্মীয়। বয়সে সায়েমের বড় হলেও বন্ধু’র মত চলাচল। ইমনের পিতা শীষ মোহাম্মদ মারা যাবার পর মামাসহ অন্যান্য স্বজনদের সহযোগিতায় লালন পালন হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ওসি সাবের রেজা আহম্মেদ বলেন, ‘ দু’ শিশু নিখোঁজের পর পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে যে ভোলাকে আটক করে তার অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে অভিযানের মূল যায়গায় যেতে পুলিশকে বেশ বেগ হতে হয়েছে। এটি একটি শিশু এ্যাডভেঞ্চারের ঘটনা। পরিবারের অমনোযোগিতার কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে’।
মঙ্গলবার দুপুরে উদ্ধার হওয়া দু’ শিশুকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ২১-১১-১৭