বাতিল হয়ে গেল সদর উপজেলার উন্নয়ন প্রকল্পের কোটি টাকা ও ৪ শ মে. টন চাল

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ও বরখাস্তাদেশ স্থগিত হওয়ার পরে উপজেলায় ‘বসতে’ না পারার কারণে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের উন্নয়ন প্রকল্পের ১ কোটিরও বেশি টাকা বাতিল হয়ে গেছে। একই সঙ্গে বাতিল হয়েছে কাবিখা ও টিআর প্রকল্পের প্রায় ৪ মেট্রিক টন চাল। চেয়রম্যানদের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে বন্ধ হয়ে রয়েছে উপজেলার হাটবাজার-ফেরিঘাটের ইজারাসহ কর্মচারীদের বেতন ভাতাও। ফলে একদিকে বেতন ভাতা না পেয়ে কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে অন্যদিকে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালের ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জামায়াত নেতা মোখলেশুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে যথাক্রমে জামায়াত নেতা মাওলানা সোহবার আলী ও জামায়াতের মহিলা সংগঠনের নেত্রী ইয়াসমিন আরা বেগম নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর ওই বছরেরই ২২ এপ্রিল রাজশাহীতে শপথ গ্রহণ করতে গিয়ে গ্রেফতার হন মোখলেশুর রহমান। ১৩ মামলার আসামী হিসেবে কারাগারের থাকা অবস্থায় তিনি শপথ গ্রহণ করলেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন শপথ গ্রহণের ৬ মাস পরে।
ওই সূত্র জানায়, উপজেলা চেয়ারম্যান মোখলেশুর রহমানের থাকা একাধিক মামলার অভিযোগপত্র আদালতে গ্রহণ হওয়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রাণালয় ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। ওই সময় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা সোহরাব আলী অনুপস্থিত থাকায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াসমিন আরা বেগমকে চেয়ারম্যানের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রাণালয়। উপজেলা পরিষদের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী জানিয়েছেন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণের পর উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। কিন্তু ‘রহস্যজনক’ কারণে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পরিষদের পরপর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকায় উপজেলা পরিষদ আইনের ১৩ (১) (ক) ধারা অনুযায়ী তিনিও অপসারিত হন। সৃষ্টি হয় পরিচালনায় নতুন সংকট।
সুংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে উপজেলা পরিষদের সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু এরইমাঝে বরখাস্ত হওয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোখলেশুর রহমান তার সাময়িক বরখাস্তের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করলে ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট সাময়িক বরখাস্তের আদেশ ছয়মাসের জন্য স্থগিত করে। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের পরও উপজেলা চেয়ারম্যান মোখলেশুর রহমান উপজেলা পরিষদেই আসেননি। ওই সূত্র জানিয়েছে, নাশকতাসহ একাধিক মামলার আসামী হওয়ায় গ্রেফতার এড়াতে তিনি পরিষদে অনুপস্থিত থাকেন। একইভাবে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা সোহরাব আলীর সাময়িক বরখাস্তের আদেশ হাইকোর্ট থেকে স্থগিত হলেও তিনিও উপজেলা পরিষদে অনুপস্থিত রয়েছেন।
উপজেলা প্রকৌশল শাখা সূত্র জানিয়েছে, উপজেলা পরিষদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলাকালে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে উপজেলা উন্নয়ন সহায়তা থোক বরাদ্দ বাবদ চার ধাপে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচি (এডিপি)’র ৫৩ লাখ ১১ হাজার টাকার বরাদ্দ পাওয়া যায়। ওই সময় জনসংখ্যা ও আয়াতন অনুপাতে ইউনিয়ন ভিত্তিক ১৭টি প্যাকেজে ৪১টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যা পরিষদের অনুমোদন স্বাপেক্ষে এ বছরের ৬ জানুয়ারি প্রকল্প গুলোর দরপত্র গ্রহণ করা হয়। প্রকল্প গুলোর মাধ্যে রয়েছে, গোবরাতলা, ঝিলিম ও সুন্দরপুর ইউয়িননে ৪টি করে, বালিয়াডাগা, বারঘরিয়া, মহারাজাপুর, শাহজাহানপুর ও ইসলামপুরে ৩টি করে, রানীহাটি, চরঅনুপনগর, চরবাগডাঙ্গা, নারায়ণপুর, দেবীনগর ও আলাতুলি ইউনিয়নে ২টি ক্ের এবং ১৪ ইউনিয়নে স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা নির্মাণে ২টি প্রকল্প।
ওই সূত্র জানায়, বিধিমোতাবেক বাস্তবায়ন প্রকল্পগুলোর অর্থ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’র যৌথ স্বাক্ষরের চেকের মাধ্যমে উঠানো হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় কোনই টাকা উঠানো যায়নি। দীর্ঘ জটিলতায় টাকা আটকে থাকা টাকা জুন মাস শেষ হয়ে যাওয়ায় তা বাতিল হয়ে গেল।
উপজেলা প্রকৌশলী আনম ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমারা বেকায়দায় আছি। ঠিকাদাররা বিলের জন্য ধর্ণা দিচ্ছে। এখন কোন উপায় নেই। এটা পরিষদিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। ঠিকাদারদের বকেয়া বিল কিভাবে পরিশোধ করা হবে তা পরিষদেই সিদ্ধান্ত নিবে’।
উপজেলা প্রকৌশল শাখা সূত্র জানিয়েছে, সৃষ্ট জটিলতার কারণে উপজেলার এডিপি’র এক বছরের উন্নয়ন থেকেই বঞ্ছিত হতে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের মানুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ নতুন অর্থ বছরের বরাদ্দ থেকে পুরাতন কাজের বিলের সমন্বয় করা হলে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প আর গ্রহণ করা যাবেনা’।
এদিকে, একই অবস্থা সৃষ্টি হয়ে ত্রাণ শাখায়। এখানে প্রথম পর্যায়ে কাবিখা খাতে ১৭৫ মেট্রিক টন চাল, টিআর খাতে ১৩৮ মেট্রিক টন চাল এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কাবিখা খাতে ৮৫ মেট্রিট টন চাল ও ২৫ লাখ টাকা এবং টিআর খাতে ৪০ লাখ টাকা বাতিল হয়ে গেল।
উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মৌদুদ আলম খাঁ বলেন, গেল সোমবার পর্যন্তও যদি সিদ্ধান্ত পাওয়া যেত। তাহলে অন্তত টাকাগুলো পরবর্তী অর্থ বছরের ব্যয়ের জন্য আটকে দেয়া যেত। কিন্তু সে সময়ও শেষ হয়ে গেল’।
অন্যদিকে, পরিষদিক জটিলতার কারণে ১৪২৩ সালের হাট বাজার ও ফেরিঘাটের ইজারা দেয়া বন্ধ রয়েছে। ইজারা দিতে না পারার কারণে তা চলছে ‘খাস কালেকশনের’ মাধ্যমে। এ নিয়ে চলছে আর্থিক অস্থিরতা। এমনকি অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে। চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের অভাবে বন্ধ আছে কর্মচারীদের বেতন ভাতাও। ফলে তারা মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। উপজেলা কর্মচারী ওবাইদুল হক বলেন, আগে ঠিকমতই বেতন পাচ্ছিলাম। সংসারও চলছিল ঠিকমতই। কিন্তু জটিলতার কারণে সব বন্ধ হয়ে গেছে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ও পরিবার পরিজন নিয়ে বেকায়দায় আছি’।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মির্জা শাকিলা দিল হাছিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ জানুয়ারি মাসে ইয়াসমিন ম্যাডাম অপসারিত হওয়ার পর থেকেই প্রতিমাসেই নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রাণালযে পত্র দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ৫ মে চেয়ারম্যান ভাইস চেয়ারম্যানদের মামলা সংক্রান্ত তথ্য ৯ মে সমস্য সমাধানে নির্দেশনা চেয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রাণালয়ে পত্র দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার (২৯ জুন) তারিখেও সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়ে পত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনই নির্দেশনা পাওয়া যায়নি’।
উদ্ভুত বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ বলেন, ‘ প্রশানসিক নির্দেশনার অভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা বাতিল হয়ে যাওয়া দুঃখ জনক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ উন্নয়ন থেকে বঞ্ছিত হলো’। তিনি পুর্বের বরাদ্দগুলো চালুসহ দ্রুত সংকট নিরসনের দাবি জানান।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক/ ০৪-০৭-১৬