বাংলা নববর্ষের সেকাল ও একাল -------------------গোলাম কবির

ভাষা ও সংস্কৃতি অনেকটা সহচর। কখন থেকে কোন ভাষা ও সংস্কৃতি পথচলা শুরু করেছে তার সঠিক ইতিহাস জানা দুঃসাধ্য। অনুমান সাপেক্ষে আমরা পণ্ডিতদের কাছ থেকে যতটুকু জেনে আসছি, তা দিয়ে ভাষা-সংস্কৃতির কাল নির্ণয় করি। কবিতার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের বাংলা সাহিত্যের বয়স প্রায় হাজার বছর। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, যে ভাষায় প্রাচীন কবিরা কবিতা রচনা করতেন, তার অনেক আগে তখনকার জনগোষ্ঠী ভাষা প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড ও ভাবের আদান-প্রদান করেছেন। সুতরাং বাংলার মানুষের কথিত ভাষার বয়স আরো প্রাচীন। আমরা বলছিলাম, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় সহচর। কাজেই বাঙালির সংস্কৃতির বয়সও প্রায় সমকালীন হলেও তার ইতিহাস ভাষার মতোই আলো-আঁধারিতেই রয়ে গেছে। আমরা যে বাঙালি, তা বাংলা কবিতার সূচনার যুগে পদকর্তা আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেছেন। ‘আজু ভসুকু বঙালী ভইলি/নিও ঘরণী চণ্ডালে লেলি’ বলে। আমরা বাঙালি তখন ছিলাম ব্রাত্যজন। বাঙালির নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড, অভাব-অভিযোগ আর বিত্তবানদের লোলুপদৃষ্টি আমরা চর্যাপদের কবিতার সমাজ-ভাবনায় প্রত্যক্ষ করি। তবে নববর্ষ উদ্যাপনের সংস্কৃতির বিষয়টি সেখানে আসেনি। মধ্যযুগের বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে বারোমাইস্যার প্রসঙ্গ থাকলেও নববর্ষের ভাবনা সেখানে প্রাধান্য পায়নি। ইতিহাস বলে শকরাজ প্রবর্তিত অব্দ অর্থাৎ শকাব্দ তখন বাংলায় প্রচলিত ছিল। তার ৫১৫ বছর পরে সম্রাট আকবরের সময় বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। তারও বয়স ৫০০ বছর হয়ে গেল। বৈশাখের ১ তারিখ তখন থেকে বাঙালির নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ মোগল সম্রাট প্রবর্তিত বলে অনেকে গর্ববোধ করেন। তাঁরাই আবার নববর্ষ উদ্যাপনকে অপসংস্কৃতি মনে করেন। দিল্লির ফরমানে ১ বৈশাখ নববর্ষ হলেও তাঁরা উদ্যাপন করতেন নওরোজ উৎসব। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় ‘বাদশাজাদা দেখলো তোমায় দেখলো প্রথম নওরোজে’ বলে নূরজাহান-জাহাঙ্গীরের প্রণয় ভাব উদ্রেকের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন। আমরা এসব বিতর্কিত বিষয়ের বিস্তার ঘটাতে চাই না।
মূলত খাজনা আদায়ের উপযুক্ত সময় নির্ধারণের জন্য পহেলা বৈশাখকে নববর্ষের দিন করা হলেও কোনো কোনোভাবে বাংলার মানুষ বছরের একটি দিনকে শুভকর্মের সূচনা হিসেবে উদ্যাপন করে এসেছে। তার প্রকৃতি কেমন ছিল, তা অনুমান সাপেক্ষে হলেও গত শতকের গোড়ার দিক থেকে বাংলার মানুষ সেসব উৎসবের ধরন প্রত্যক্ষ করে এসেছে।
কৃষিভিত্তিক জীবন বাংলার আদি সমাজব্যবস্থা। তাই কৃষির অনুষঙ্গ উপকরণ উত্পাদন আর অন্যান্য নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনের দ্রব্যাদি তৈরিতে কাঠমিস্ত্রি, কামার, কুমার, তাঁতি, চামার প্রভৃতি কর্মজীবী মানুষ সমাজকে সচল রাখতেন। তাঁদের কর্মকাণ্ড ও লোকজ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল বাংলার সংস্কৃতির উপজীব্য বিষয়। তাই বলে বাংলার সব স্থানের মানুষের একই ধরনের আচার-অনুষ্ঠান ও খাদ্যাভ্যাস ছিল তা বলা যাবে না। তবে ধরনটা ছিল প্রায় একই রকমের।
জানা যায়, চৈত্রসংক্রান্তি থেকে নববর্ষের আয়োজন শুরু হতো। নববর্ষের দিন আনন্দ-উল্লাসের ভেতর দিয়ে বাংলার মানুষ গ্রামে-গঞ্জে প্রাণভরে তা উপভোগ করতেন। চৈত্রসংক্রান্তিতে চড়ক বা গাজন উৎসবের পরের দিন নব উদ্যমে নববর্ষকে আবাহন করা হতো। কৃষি উত্পাদনের উপকরণ যেমন— লাঙল-জোয়াল, লাঙলের ফলা, দা, কাস্তে, খুন্তি, কোদাল, গরুর গাড়ির চাকা, ধুরি, চাত্রা ইত্যাদিসহ পারিবারিক প্রয়োজনের অনেক কিছুই মেলায় বিক্রি হতো। গ্রামীণ মানুষের বিনোদনের জন্য ব্যবস্থা থাকত কবিগান, যাত্রা-অভিনয়ের। মোটামুটি এমনটি ছিল সেকালের নববর্ষ।
এ কালের নববর্ষের চেহারা পরিবর্তিত হতে থাকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইংরেজদের খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদ্যাপনের চোখধাঁধানো আড়ম্বরকে সামনে রেখে। বলা হয়ে থাকে বাঙালির বিকাশোন্মুখ আধুনিক সংস্কৃতির পর্যায় শুরু হয় ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে। তবে তারও আগে রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) ১৮৫১ থেকে ১৮৬৮ পর্যন্ত মেদিনীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় প্রথম বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করে তখনকার নগর বাংলার শিক্ষিত বাঙালিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রথম জীবনে ইংরেজিয়ানায় আকৃষ্ট থাকলেও পরিণত বয়সে রাজনারায়ণ বাঙালির মুক্তি ভাবনায় নিবেদিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন স্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন, ‘জ্যোতিদাদার উদযোগে আমাদের একটি সভা (সঞ্জীবনী সভা), বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বাবু ছিলেন তাহার সভাপতি। ইহা স্বাদেশিকতার সভা।’ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং স্বদেশি সমাজ ও মেলার মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে মনোনিবেশ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে বাংলা নববর্ষের উদ্যাপন তাঁর উদ্যোগে পূর্ণতা লাভ করে। এ সময়ে উদ্যাপনের প্রধান বিষয় ছিল সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, তার সঙ্গে দেশজ শিল্প ও লোকশিল্পের সমাগম।
উনিশ শতকের নগরকেন্দ্রিক সমাজে বণিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্যবসায়ীরা সারা বছরের হিসাব-নিকাশ আনন্দঘন পরিবেশে নববর্ষের দিন উদ্যাপন শুরু করেন। সেই মিঠাই-মণ্ডা সহযোগে সারা বছরের ক্রেতাদের আপ্যায়নের সংস্কৃতি আর নেই বললেই চলে। তাই নববর্ষের হালখাতাও চোখে পড়ার মতো হয় না। আর পঞ্জিকা প্রকাশের যে ঢল নামত, তাও আর দৃশ্যমান নয়। কারণ আমরা খ্রিস্টীয় পঞ্জিকায় জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডই কেবল নয়, জাতীয় দিবসগুলোও তার আওতায় এনে ফেলেছি। ২৫শে বৈশাখ, ২২শে শ্রাবণ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ এর সম্মান রক্ষা বাদে পহেলা বৈশাখ বাঙালির সঞ্জীবনী সুধা রূপে টিকে আছে। ধর্মীয় চেতনার চৈত্রসংক্রান্তি এখন কাগজে-কলমে। বঙ্গীয় সন-তারিখ কৃষিকাজে সম্পৃক্ত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবুও আশার কথা, বাংলা নববর্ষ এখন নাগরিক জীবনের অসাম্প্রদায়িক বিনোদনের একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আমানি কাঁজির স্থান দখল করেছে শখের পান্তা আর সাধারণের নাগালের বাইরে ইলিশ মাছ। রমনার বটমূল থেকে শুরু করে সারা বাংলার শহরে-বন্দরে নববর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে মহা আড়ম্বরে। বাহারি কাপড়চোপড় পরে সকাল বেলায় নির্দিষ্ট স্থানে বোশেখকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করছে একঘেয়ে নাগরিক মানুষ। গ্রামীণ সেই নববর্ষ দখল করেছে নগরকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে মৃৎশল্পের মর্যাদার এবং বাঙালির ফেলে আশা দিনগুলোর নানা ধরনের পিঠাপুলি নাগরিক মানুষের রসনা পরিতৃপ্ত করছে। জীবন ও সংস্কৃতির বিবর্তনের ধারায় আজকের দিনে বাংলা নববর্ষের যেটুকু ধরে রাখতে পারা গেছে তার মূল্য কম নয়। যদিও ‘মুমূর্ষুরে’ আমরা উড়িয়ে দিতে পারিনি, পারিনি ‘অগ্নিস্নানে’ আমাদের এই স্বর্গের বাড়া বাংলাদেশ তথা ধরণীকে পূত-পবিত্র করতে।

লেখক : রাজশাহী কলেজের সাবেক শিক্ষক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃতি সন্তান

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ/ সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ, ১৪-০৪-১৬/