ভাষা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই----------জহিরুল ইসলাম

বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা। অনেক রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা। আমাদের ভাষার অর্জন বায়ান্নতে। প্রায় সতের কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। শুধু আমরাই নই, আমাদের দেশের বাইরেও কয়েক কোটি মানুষ কথা বলে এই ভাষায়। আজ আমাদের ভাষার সাহিত্য পৃথিবীর প্রথম সারিতে ঠাঁই করে নিয়েছে। ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের ঘটনা অন্য কোনো ভাষার জন্য শোনা যায় না। আমরা যেমন মাকে ভালোবাসি, তেমনি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। তাই তো মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে অনেককে।
আর ক’দিন পরেই একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই আমরা বাংলা নিয়ে কথা বলি। বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনা করি। সবখানে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা করা হয়। জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য প্রদান করা হয়। ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। একুশের প্রভাতফেরিতে গিয়ে ফুল দিয়ে আসি। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ, আলোচনা শেষ। ব্যানার ভাঁজ করে রেখে দেয়া হয় পরের বছরের জন্য। এভাবেই চলছে। অথচ যে ভাষার জন্য আমাদের সূর্য সন্তান সালাম, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো কতজন প্রাণ দিয়েছেন, সে ভাষার বিকৃতি চলছে নগ্নভাবে। বাংলা ভাষায় আধুনিকতার নামে ইংরেজি ভাষা ঢুকিয়ে এক ধরনের বাংলিশ করে তুলে ধরা হচ্ছে। বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, বাংলা বর্ণমালা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে; অথচ আজ বাঙালি তার ওইসব মহৎ অর্জনগুলো বর্জন করে মাতৃভাষা বাংলাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীনতা ও বাংলায় অন্য ভাষা ঢুকিয়ে ভাষার অবমাননা জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেট করে দেয়।
ইতিহাস মতে, মানুষের মধ্যে যতদিন ভাষার উদ্ভব না হয়েছে, ততদিন সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়নি। মানুষ যখন ভাষার সাহায্যে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে নির্দেশ ও সম্পর্কিত করতে পেরেছে, তখন থেকেই সভ্যতার শুরু। মানুষ লিখতে শিখেছে পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে; কিন্তু বলতে শিখেছে অন্তত ষাট হাজার বছর আগে। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে বহু ভাষার উদ্ভব হয়েছে, আবার তা বিলীন হয়ে গেছে, যেমন অনেক সভ্যতার উত্থান ও পতন ঘটেছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অনেক বড় বড় সভ্যতা ও অসংখ্য ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ইতিহাস স্মরণীয়। একসময় উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় অসংখ্য 'রেড ইন্ডিয়ান' ভাষা প্রচলিত ছিল। কয়েকশ’ বছর আগে ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশে পরিণত হওয়ার ফলে সেসব ভাষা ধ্বংস হয়ে গেছে। উত্তর আমেরিকায় চালু হয়েছে ইংরেজি আর দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষা।
আমাদের দেশে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার জন্য আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ই বেশি দায়ী। আধুনিকতার নামে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে এবং সস্তা প্রশংসা লাভের জন্য বাংলা ভাষার সাথে ইংরেজি জুড়ে দিয়ে কথিত যুগের উপযোগি করে তোলার নামে বিকৃত করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি বিকৃতি হচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেল ও এফএম রেডিও স্টেশনগুলোতে। টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত 'সিরিয়াল'গুলোয় ব্যবহৃত ভাষা প্রায়ই না প্রমিত, না কোনো অঞ্চলের নির্দিষ্ট উপভাষা। এসব সিরিয়ালের রচয়িতা ও কুশীলবরা যে খিঁচুড়ি ভাষা ব্যবহার করেন, তা দর্শকের বোধগম্য নয়। এসব সিরিয়ালগুলোর মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিকৃতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। আগেও বাংলা নাটক প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যেও বিশেষ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা বিদ্যমান। সেসব আঞ্চলিক ভাষায় নাটক প্রচারিত হয়েছে এবং দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। সেটা থাকতেই পারে। কখনো বাংলা ইংরেজি আঞ্চলিকতা একসাথে মিলিয়ে রচিত হয়নি। আজ একুশ শতকে এসে আধুনিক মাধ্যমে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত সিরিয়ালগুলোতে এক অদ্ভুত ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে বোধগম্য নয়। ভাষা ব্যবহারের এ নৈরাজ্য আমাদের মেধা ও মননকে প্রভাবিত করছে এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রতিভাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। বাংলা ভাষায় রয়েছে হাজার বছরের সাহিত্য ও ঐতিহ্য। সুদীর্ঘ পরাধীনতা যা ধ্বংস করতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশকের মধ্যেই বাংলাদেশের মাতৃভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা, উপেক্ষা এবং নৈরাজ্য এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, বাংলা ভাষার মাধুর্য ও সৌন্দর্য প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহারে যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে মনে হয় না যে, পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা বা ত্রিশ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা এ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে।
প্রতিদিন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে টকশো নামের যে অনুষ্ঠান করা হয়, সেখানে অনেক শিক্ষিতজন, বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনীতিক উপস্থিত হন। অধিকাংশই বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন। এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের শিরোনামও ইংরেজিতে হয়। আর এফএম রেডিও চ্যানেলগুলোর অবস্থা তো আরও করুণ। কখনো ইংরেজি-বাংলার, কখনো হিন্দি, যে যেভাবে পারছেন বাংলা ভাষাকে টেনে হেঁচড়ে একাকার অবস্থা। তরুণ প্রজন্মরা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই তরুণ প্রজন্মের উপর সবচেয়ে প্রভাব ফেলে এসব বিষয়। অথচ আমাদের প্রিয় ভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাও।
আমি আগেই বলেছি, বাংলা ভাষার সাহিত্য পৃথিবীতে ১ম সারিতে ঠাঁই করে নিয়েছে। এই ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশী মানুষ রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি কফি আনানকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সেই চিঠির সূত্র ধরে ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। সেই উপদেশ অনুযায়ী রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে চার ভাষাভাষী চারজন সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” (Mother Language Lovers of the World)-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন। এভাবে তারা দিন রাত পরিশ্রম করে অবশেষে ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯। এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় সভার প্রথমেই। ১৮৮টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানান। কোন দেশই এর বিরোধিতা করেননি, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়। সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়। আমাদের ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান পেল। অথচ আমরা নিজেরা আমাদের মাতৃভাষার প্রতি অসম্মান অবজ্ঞা করে চলেছি।
মাতৃভাষার প্রতি আমরা কতটা মমত্বহীন অবহেলা যে কতটা ব্যাপক, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাস্তার দু’পাশে বিজ্ঞাপন-সাইনবোড-বিলবোর্ডগুলো দেখলে। বিচিত্র বানানের শব্দাবলি, যা কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না। ভুল বানানের মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি।
কয়েক বছর আগে উচ্চ আদালত থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বাংলা ভাষার দুষণ, বিকৃত উচ্চারণরোধে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে পদক্ষেপ নেবে। একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আর কি হয়েছিল সে খবর জানা যায়নি।
বর্তমান বাংলাদেশে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য ও বিকৃতি চলছে, এর গতিরোধ করতে না পারলে বাংলা ভাষা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তির পথে চলে যাবে। বিশ শতকে বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, বাংলা বর্ণমালা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে; কিন্তু একুশ শতকে এসে বাঙালি তার ওইসব মহৎ অর্জনগুলো বর্জন করে তার মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিচ্ছে। তাই আর সময় নেই। আমাদের ভাবতে হবে এখনই। মাতৃভাষার এই মাসে আমাদের শপথ নিতে হবে, আগে আমাদের ভাষা, পরে অন্য ভাষা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই, আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, পরে ইংরেজি ভাষার পত্তন।

লেখক : প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি, ঢাকা।